পবিত্র রমাদ্বান মাস কুরআনের মাস। এই মাসে আমাদের উচিত নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা, কুরআন বুঝে পড়ার মাধ্যমে কুরআনের সৌন্দর্য্য উপলব্ধি করা।
কুরআন এক অলৌকিক কিতাব। অন্য সকল নবীদেরকে যেসব মুযিজা দান করা হয়েছিলো, সবার চাইতে বড় মুযিজা কুরআন দান করা হয়েছে আমাদের রাসূলকে (স)। কেন কুরআন অলৌকিক? কেন কুরআনের সমতূল্য কোনো কিতাব নেই? কেন কাফিররা কুরআনের সমতূল্য একটি সূরা কিংবা কয়েকটি আয়াতও বানিয়ে আনতে পারে নি? এর অন্যতম একটি কারণ হলো এর ভাষাশৈলী। কুরআন আরবী ভাষার মধ্যে সবচাইতে সমৃদ্ধ ভাষাশৈলী প্রয়োগ করেছে।
অথচ এই কুরআন এসেছে মৌখিকভাবে ও বিক্ষিপ্ত আকারে। একসাথে এই কুরআন নাযিল হয় নি। ২৩ বছরে অল্প অল্প করে নাযিল হয়েছে, মৌখিকভাবে সংরক্ষিত হয়েছে। কিন্তু কুরআনের ভাষাগত এমন সব মুযিজা আছে, যেগুলো লিখা ছাড়া মৌখিকভাবে প্রকাশ করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই মুযিজাগুলোকে একত্র করেছেন উস্তাদ নুমান আলী খান। তাঁর Linguistic Miracles of the Quran লেকচার অবলম্বনে আমার এই সিরিজ ‘কুরআনের অলৌকিক ভাষাশৈলী’। রমাদ্বান মাসে আমি আপনাদের একটু একটু করে দেখাবো ঐশী বাণীর সৌন্দর্য্য। আল্লাহ তাওফীক দিন। আমীন।
১. সূরা মুদ্দাসসির: ৩
وَ رَبَّکَ فَکَبِّرۡ
এই وَ শব্দটা সাধারণত বাক্যের শুরু বোঝায়। কুরআনে অনেক বাক্য আল্লাহ وَ শব্দ দিয়ে শুরু করেছেন।
এর পরের শব্দগুচ্ছটি খেয়াল করি। অর্থাৎ, رَبَّکَ فَکَبِّرۡ এই শব্দগুচ্ছে খেয়াল করুন প্রথম এবং শেষ শব্দ ر, ২য় ও ৬ষ্ঠ শব্দ ب, ৩য় ও ৫ম শব্দ ك এবং একদম মাঝের শব্দটি ف. পাঠক, খেয়াল করুন, এটি কিন্তু একটি প্যালিন্ড্রম শব্দ। যেমন- ইংরেজিতে level, madam, racecar. বাংলায় নবজীবন, কথক, নবীন ইত্যাদি।
এখন আসি, এই আয়াতটির অর্থ কী?
“আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর।”
এখন এই লাইনটিকে আপনি বাংলা, ইংরেজি, ফার্সি, স্প্যানিশ যেকোনো ভাষায় প্যালিন্ড্রোম বানান তো দেখি! এবং অবশ্যই সেটা হতে হবে মুখে মুখে। লিখে চেষ্টা করা যাবে না। কঠিন, তাই না? কিন্তু, বিশ্বজাহানের রবের জন্য মোটেই কঠিন নয়।
২. সূরা বাকারা: ১৪৩
সূরা বাকারা কুরআনের বৃহত্তম সূরা। এর আয়াত সংখ্যা ২৮৬ টি। এই সব আয়াত কিন্তু একদিনে নাযিল হয়নি। সুদীর্ঘ ১০ বছর ধরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে আলাদা আলাদা করে নাযিল হয়েছে। এই সূরা বাকারায় একটি আয়াত আছে, وَ کَذٰلِکَ جَعَلۡنٰکُمۡ اُمَّۃً وَّسَطًا. এর অর্থ কী জানেন?
“আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি।”
এই وَّسَطًا মানে হলো মধ্যম বা মাঝে। এই কথাটি কতো তমো আয়াতে আছে জানেন? ১৪৩, অর্থাৎ ঠিক সূরা বাকারার মাঝে!
দেখুন, লিখিতভাবে ব্যাপারটা হয়তো সহজ। কিন্তু, মৌখিকভাবে চিন্তা করুন! এতোটাই কি সহজ? তাও দুটো রেস্ট্রিকশন আছে। প্রথমত, আয়াতগুলো বিক্ষিপ্তভাবে দীর্ঘ সময় ধরে নাযিল হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তখন আয়াতে নাম্বারিং করা হতো না। তাঁরা আয়াত মুখস্ত রাখতেন, সিরিয়াল মুখস্ত রাখতেন। কিন্তু অমুক সূরার এতো নং আয়াত, এভাবে রাখতেন না। এই বিষয়টা তখন ছিলোই না। এরপরও কি সুন্দর মিল তাই না? বিশ্বজাহানের প্রতিপালক তো সৌন্দর্য্যপ্রিয়!
৩. সূরা আহযাব: ৪
مَا جَعَلَ اللّٰہُ لِرَجُلٍ مِّنۡ قَلۡبَیۡنِ فِیۡ جَوۡفِہٖ
“আল্লাহ কোন মানুষের (পুরুষ) অভ্যন্তরে দু’টি হৃদয় সৃষ্টি করেননি।”
এই رَجُلٍ শব্দটা দ্বারা এক্সক্লুসিভলি পুরুষ বোঝায়। এখানে নারীদেরকে বাদ দেয়া হয়েছে? কিন্তু কেন? তার মানে কি নারীদের দুটো হৃদয় থাকতে পারে?
হ্যাঁ পারে। যখন নারী গর্ভবতী থাকে, তখন তার ভেতরেই আরেকজন মানুষের হৃদয়ও থাকে। তাই, এখানে নারীকে বিশেষভাবে বাদ দেয়া হয়েছে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, কুরআনে যতোবারই হৃদয়ের কথা এসেছে, সব জায়গায় বলা হয়েছে হৃদয় আছে বুকের ভেতর। কিন্তু, এই আয়াতে আল্লাহ ব্যবহার করেছেন جَوۡفِہٖ শব্দটি যেটি দ্বারা সম্পূর্ণ শরীর বোঝায়। এমনটা বলার কারণ কী?
কারণ, যখন একজন নারী গর্ভবতী হয়, তখন তার ভেতরে দুটো হৃদয় থাকলেও দুটোই বুকের মাঝে থাকে না। বরং, তার সন্তান থাকে তার পেটে। তাই, একই শরীরের মধ্যে দুটো হৃদয় থাকলেও, বুকের মাঝে দুটো হৃদয় থাকে না।
তাই, আল্লাহ এখানে বুক ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ শরীর শব্দ ব্যবহার করেছেন। ভাষার কতো সতর্ক ব্যবহার, সুবহান-আল্লাহ!
এই সিরিজে আমরা ধারাবাহিকভাবে কুরআনের ভাষাগত অলৌকিকতাগুলো তুলে ধরবো ইন-শা-আল্লাহ।
সোর্স-
মূল : উস্তাদ নোমান আলী খান
অনুবাদ : আসিফ মাহমুদ
ফেসবুক টাইমলাইন থেকে