এক অন্তর্ঘাতী দূর্যোগের কবলে পতিত আমাদের সময়। নিজেদের ভোগ-স্বার্থের জন্য তাচ্ছিল্যবশে আমাদের একমাত্র জ্ঞাত আবাসভূমি এই পৃথিবীকে অ-বাসযোগ্য করে তুলছি আমরা কিংবা আমাদের পাশে হাঁটতে থাকা মানুষটি। আমাদের যেমন জানা উচিত ঠিক কারা কারা, কোন মানুষগুলো আমাদের বেঁচে থাকাকে কষ্টকর করে তুলছে। পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আমাদের এটাও জানা উচিত সাধারণের মত দেখতে কোন কোন অসাধারণ মানুষগুলি আমাদের এবং আমাদের পৃথিবীটাকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত।
তাহলে বলতে হয় মোবারক আহমদ এর কথা পরিবারে তাকে সবাই চিনে খসরু নামে। বাল্যকাল থেকেই মেধাবী ছাত্র খসরুর আগ্রহ ছিল সাইন্টিফিক এক্সপেরিমেন্টের প্রতি। ছোটবেলায় বিজ্ঞান বইয়ের ছবি আঁকা পরীক্ষাগুলো বাসায় নিজে নিজে করে দেখতেন। কখনও সফল কখনও ব্যর্থ, ব্যর্থতা তাকে থামায়নি বরং গবেষণার প্রতি আরও আগ্রহী করে তোলে।
কাজ করেছেন জার্মানিতে ডিএএডি এবং অ্যাভিএ’র সহকর্মী হিসেবে, জাপানে জেএসএসএস, এমআইএফ এর ফেলো হয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি) এবং অস্ট্রেলিয়ায় আইএইএ এর সহযোগী হিসেবে।
বাংলাদেশ সোনালী আঁশের দেশ। একটা সময় ছিল যখন এই দেশের অর্থনীতি ছিল কৃষি নির্ভর। বৈদেশিক মুদ্রার অধিকাংশ অর্জিত হতো কৃষিখাত থেকে। যার সিংহ ভাগ আসতো পাট থেকে। আশির দশকে তৈরি পোশাক ও চিংড়ি রপ্তানি শিল্পের প্রসার ঘটে। এরপর থেকে অর্থনীতিতে কমতে থাকে পাটের অবদান।
গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে পলিব্যাগের ব্যবহার পাটের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে আরো ম্লান করে দেয়। দামে সস্তা আর সহজে ব্যবহার উপযোগী হলেও পলিথিন ব্যাগ পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই অনেকদিন ধরেই পরিবেশবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো পলিথিনের বিকল্প খুঁজে আসছিলো। যার উত্তর খুঁজে বের করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ডঃ মোবারক আহমদ খান।
সেই নব্বই এর দশক থেকে ডঃ মোবারক আহমদ খান পাটের বাণিজ্যিক ব্যবহার ও সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করে চলেছেন। প্রকাশ করেছেন এই সম্পর্কিত শতশত গবেষণামূলক প্রকাশনা। বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা সম্পর্কিত ওয়েব-সাইট স্কোপজের মতে, তিনি সারা বিশ্বের পাট গবেষকদের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) একজন প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থায়ই তিনি পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি সোনালী ব্যাগ আবিষ্কার করেন।
পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি সোনালী ব্যাগ
ডঃ মোবারক আহমদ খান বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন পেশাগত জীবনে। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা রসায়ন বিভাগে। তিনি রসায়নে এমএসসি ও বিএসসি এবং পলিমার ও তেজস্ক্রিয় রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি ন্যানোটেকনোলজি, ম্যাটরিয়াল সাইন্স, বায়োডিগ্রেডেবল পলিমার, বায়োমেডিক্যাল সাইন্স সহ বিজ্ঞানের নানান শাখায় কাজ করে যাচ্ছেন।
ডঃ খানের উদ্দেশ্য পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। তিনি জার্মানিতে ডিএএডি এবং অ্যাভিএ’র সহকর্মী হিসেবে, জাপানে জেএসএসএস, এমআইএফ এর ফেলো হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি) এবং অস্ট্রেলিয়ায় আইএইএ এর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি আইইউপিসি এর ফেলো হিসাবেও নির্বাচিত হন।
তিনি ১৭ টি বই এবং একটি পেটেন্টসহ ৬০০ টির বেশি প্রকাশনার লেখক অথবা সহ-লেখক। এছাড়া তিনি ২০০’র অধিক এমএসসি ৮জন এম ফিল ও ২০জন পিএইচডি শিক্ষার্থীর তত্ত্বাবধান করেছেন। তার উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে অন্যতম পাট থেকে পলিব্যাগ (সোনালী ব্যাগ), গরু হাড় থেকে উন্নত ক্ষত জিবাণুমুক্ত করন উপাদান, টেক্সটাইল দূষণ থেকে তরল জৈব সার, প্রাকৃতিক উদ্ভিদ বৃদ্ধির প্রবর্তক প্রন শেল, পাটের তৈরি হেলমেট, পাটের তৈরি টাইলস ইত্যাদি। তিনি জুটিনের আবিষ্কারক (পাট রাইফোর্সড পলিমার কোরিগেটেড শীট)। জুটিন হচ্ছে পাটের তৈরি এক ধরনের পরিবেশ বান্ধব ঢেউটিন।
ডঃ খান সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরুপ দেশি- বিদেশী নানান পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি পাট সম্পর্কিত গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে স্বর্ণপদকে পুরস্কৃত করেন ডঃ মোবারক আহমদ খানকে । ২০১৬ সালে তিনি জাতীয় পাট পুরস্কার, ২০১৭ সালে ফেডারেশন অব এশিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি পুরস্কার অর্জন করেন। বিশ্বের স্বনামধন্য ব্যক্তিদের তথ্যসূত্রের প্রকাশনা ‘হুজ হুতে’ ডঃ মোবারক আহমদের নাম প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে।
তিনি পাট ভালোবাসেন। বলেন, আমি যেখানেই যাই, হাতে করে একগাছি পাট নিয়ে যাই। এইটা তো একান্তই আমাদের।
বেলায়েত হোসেন
চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি