মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান নৌবাহিনীর ৯ জন বাঙালি সাবমেরিনারের (ডুবোজাহাজের নৌসেনা) রোমাঞ্চকর পলায়ন এক ঐতিহাসিক ঘটনা যার সূত্রপাত দক্ষিণ ফ্রান্সের ভূমধ্যসাগর উপকূলে তুলোঁ নৌঘাঁটিতে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর জন্য ফ্রান্সে নির্মিত পিএনএস ম্যানগ্রো ডুবোজাহাজটি চালনার প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ নেয়া সহ তা পরিচালনার জন্য তখন সেখানে অবস্থান করছিলেন ৫৪ জন পাকিস্তানি নৌসেনা যাদের মধ্যে ১৪ জন ছিলেন বাঙালি। উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি নৌবহরে ফ্রান্সে-নির্মিত তিনটি ডুবোজাহাজের অন্যতম ছিলো এস ১৩৩ পিএনএস ম্যানগ্রো। অন্য দুটির নাম যথাক্রমে এস ১৩১ পিএনএস হাঙ্গর ও এস ১৩২ পিএনএস শুশুক।
ম্যানগ্রো’র কমান্ডিং অফিসার ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি লে. কমান্ডার শামীম এ খালিদ। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে তুলোঁ নৌঘাঁটিতে শুরু হয় ওই ডুবোজাহাজটির পরীক্ষামূলক পরিচালন মহড়া। এর মাঝে ১৯৭১ সালের মার্চ চলে আসে। সে’সময় ম্যানগ্রোর টেলিগ্রাফিস্ট ছিলেন ২৬ বছর বয়সী বাঙালি নৌসেনা আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী যিনি সরাসরি কমান্ডিং অফিসারের অধীনে কাজ করতেন। সাবমেরিনের যোগাযোগ ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকায় দেশবিদেশের খবরাখবর তিনি পেতেন সবার আগে।
সেখানে বসে দেশের অসহযোগ আন্দোলন সহ মার্চের উত্তাল ঘটনাবলীর সব খবরই তারা পেতেন। তেমন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষনে অনুপ্রানিত ও উদ্বুদ্ধ হওয়া সহ ২৫ মার্চের “অপারেশন সার্চলাইট” এর ফলশ্রুতিতে মাত্র দুই দিনে ঢাকা ও সংলগ্ন অঞ্চলে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ নিহত হওয়ার খবরে ওয়াহেদ চৌধুরী প্রচন্ড বিচলিত হয়ে পড়েন।
মনস্থির করেন গোপনে পক্ষত্যাগ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন। তবে সেই সাথে তার বাঙালি সহকর্মীদের যুক্ত করতে তিনি মনস্থ করেন। উল্লেখ্য সাবমেরিনের কমান্ডিং অফিসারের সেক্রেটারি হবার সুবাদে সাবমেরিনের সিন্দুক খোলার গোপন কোড তার জানা ছিলো
ওই সিন্দুকে ছিলো সাবমেরিনের গোপনীয় দলিলপত্র এবং নৌসেনাদের পাসপোর্ট। প্রথমেই তিনি ১৪ জন বাঙালি নৌসেনার পাসপোর্ট সেখান থেকে সরিয়ে ফেলেন। এরপর চরম গোপনীয়তার মাঝে তাদের ১৩ জনকে আলাদা আলাদা ভাবে তিনি তার পলায়ন পরিকল্পনার কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করতে আমি এখান থেকে পালাতে চলেছি, আপনি কি আমার সাথে যোগ দিতে প্রস্তুত?’ তার এ’কথায় ১৩ জনের মধ্যে ৮ জন সহকর্মী সাড়া দেন। উল্লেখ্য তুলোঁ নৌঘাঁটি হতে ১ এপ্রিল পিএনএস ম্যানগ্রো’র করাচির পথে যাত্রা নির্ধারিত ছিলো। এমতাবস্থায় পলায়ন পরিকল্পনা মোতাবেক তাদের যা করার তা তার আগেই করতে হবে মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। সেই লক্ষ্যে ২৯ মার্চ ওই ৯ জন বাঙালি নৌসেনা কেনাকাটার অজুহাতে তুলোঁ নৌঘাঁটি হতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আলাদা আলাদা ভাবে বেরিয়ে আসেন এবং প্রায় মধ্যরাতে তুলোঁর ৪৮ কিলোমিটার পশ্চিমে মাঁসেই রেলস্টেশনে মিলিত হন। ওয়াহেদ চৌধুরীর হাতে তখন সবার পাসপোর্ট। রেলস্টেশনে তিনি প্রত্যেকের হাতে তার পাসপোর্ট তুলে দেন।
১ম পর্ব শেষ দ্বিতীয় পর্ব পরবর্তী অংশে
[মেসবাউল হক – এর ফেইসবুক থেকে]