ইন্টারের ফিজিক্স সেকেন্ড পেপার এক্সাম ছিলো আজ। কেন্দ্র পড়েছে ঢাকার এক সরকারী কলেজে। স্টুডেন্ট গাজীপুর থেকে ভোর ছটায় রওনা হয়েছে, পরীক্ষা শুরু হবে দশটায়। প্রয়োজনেরও প্রায় তিনগুন সময় ছিলো হাতে। ছয়টা পয়ত্রিশে ও বোর্ডবাজার জ্যামে পড়ে। সেখানে কিছুক্ষন জ্যামে বসে থেকে থেকে যখন বুঝলো এই জ্যাম কয়েক কিলোমিটার লম্বা, সহজে ছুটবার নয়; তখন বাস থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করলো।
দৌড়ে আর হেটে ছেলেটা বোর্ডবাজার থেকে টঙ্গী স্টেশন রোড- বিশাল এই দূরত্ব পার হলো প্রায় দুই ঘন্টায়। গত দুদিনের বৃষ্টিতে গাজীপুরের খানা-খন্দে ভরা নিকৃষ্ট রাস্তায় পানি জমে চলাচলের অযোগ্য হয়ে আছে। দুটো ট্রাক উল্টে পড়ে আছে রাস্তায়, সেজন্য মাইলের পর মাইল লম্বা বাস ট্রাকের লাইন।
পথিমধ্যে ও পাঠাও উবারের মোটরসাইকেলও খুজেছে। এই বৃষ্টি আর জ্যামে রাস্তায় কিছুই নেই। যে দু একটা বাইক পেলো সেগুলোও যেতে চাচ্ছে না জায়গায় জায়গায় হাটু অব্দি পানি জমে যাবার কারনে। ছেলেটার মন অনেক নরম, হার্ট খুব পোক্ত না। অল্পতে প্যানিক করে। পরীক্ষার বাকি আর মাত্র দু ঘন্টা, এখনো গাজীপুর পেরোয় নি। ও অস্থির হয়ে পড়লো। আতঙ্কে কি করবে কিছু বুঝতে পারছিলো না বেচারা। এতো দূর দৌড়ে এসে পা আর কোনোমতেই চলে না। জ্যাম একটু নড়তেই একটা বাসে চড়ে বসলো। স্টেশন রোড থেকে সেই বাসে এয়ারপোর্ট আসতে আসতে সাড়ে নয়টা। পরীক্ষার বাকি আর মাত্র ত্রিশ মিনিট। ওর তখন পাগল পাগল অবস্থা।
ওর দিশেহারা কান্না কান্না চেহারা দেখে বাসের সবার মন আর্দ্র হয়ে গেলো। এক মহিলা যাত্রী চিৎকার করে ড্রাইভারকে বলেই বসলো, আপনি ছেলেটার এই অবস্থা স্বত্ত্বেও জায়গায় জায়গায় থেমে লোক উঠাচ্ছেন কেনো? আপনার এতো টাকা লাগলে আমি দিবো, আপনি দ্রুত নিয়ে যান ছেলেটাকে।”
কিছুক্ষন পর কজন বললো, “তুমি তো কেন্দ্রে সময় মতো পৌছুতে পারবা না, একটা সিএনজি নিয়ে চলে যাও”। সিএনজি পেলে তো হতোই। সারা রাস্তা খালি। কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচে এসে একটা সিএনজি দেখা গেলো। ড্রাইভার নিজে থেকেই বাস সাইড করে সিএনজির সামনে দাড় করালো। কপাল এমন খারাপ, ড্রাইভার যাবে না ওদিকে এই বৃষ্টির মাঝে। পরে বাসের সব যাত্রীরা নেমে সবাই মিলে সিএনজি ড্রাইভারকে অনুরোধ করলে সে রাজি হয়।
আমার স্টুডেন্ট ড্রাইভারকে কাদো গলায় বললো যত দ্রুত পারেন কেন্দ্রে নিয়ে যান চাচা। ড্রাইভারও তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে চিৎকার, চেচামেচি করে সামনের গাড়ি সরিয়ে এগিয়ে যেতে। সেসময় সিএনজি ড্রাইভারের ফোন থেকে ও বাসায় কলে করে জানায় এ পরিস্থিতির কথা। আমি তখন ঘুমিয়ে ছিলাম, ফোনকলে ওর আম্মুর কান্নাকাটি শুনে কি করে উঠবো বুঝতে পারছিলাম না। ওকে ফোন করে কিছু একটা উপায় বাতলে দেবো সেই উপায়ও নেই। ফোন নিয়ে যায়নি সাথে করে।
শেষমেশ কেন্দ্রে যখন পৌছুলো তখন ঘড়িতে বাজে দশটা চল্লিশ। অলরেডি চল্লিশ মিনিট লেইট। বৃষ্টিভেজা শরীরে হন্তদন্ত হয়ে হলে ঢুকে গার্ডে থাকা টিচার, হল সুপারদের কনভিন্স করতে করতে আরো দশ পনেরো মিনিট। ও যখন হাতে খাতা পেলো তখন বাকি আর চল্লিশ মিনিট। গার্ডে থাকা ম্যাডাম বললে, আগে সৃজনশীল দাও, তারপর শেষে নির্ব্যাক্তিক প্রশ্ন দিবো।
ওর প্রিপারেশন খুব ভালো ছিলো। পাচটা অধ্যায়ের মধ্যে চল তড়িৎ, ভৌত আলোক বিজ্ঞান আর আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান অধ্যায় তিনটা একেবারে ঝাঝড়া করে গেছিলো। আর প্রশ্নও এসেছিলো আজ সহজ। প্রায় সবগুলো সৃজনশীলই কমন পড়েছে।
ওর সময় হাতে চল্লিশ মিনিট। মাত্র আধ ঘন্টায় দুইটা সৃজনশীল লিখে শেষ করে ফেললো। ওর কথা অনুযায়ী দুইটাতে বিশে বিশ পাবার কথা। বাকি আছে দশ মিনিট। ও দাড়িয়ে ম্যাডামের কাছে নৈর্ব্যক্তিক চাইলো।ম্যাডাম এসে নরম গলায় বললো, “তোমার মন খারাপ হবে তাই বলি নি। তোমাকে MCQ প্রশ্ন দিতে না করেছে হল সুপার দেরির জন্য”।
ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। নৈর্ব্যক্তিক না দাগাতে পারলে শিওর ফেইল আসবে। এতোক্ষন পরে এ আবার কি কথা! ও কান্নাকাটা শুরু করে দিলো। গার্ডের ম্যাম আন্তরিক ছিলেন। উনি প্রিন্সিপলকে ডেকে আনলেন। প্রিন্সিপল জেলা মেজিস্ট্রেটকে ফোন দিলো। ওপাশ থেকে বলা হলো কোনোভাবেই নৈর্ব্যক্তিক দাগাতে না দিতে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এক রূমে বসে মহামান্য মেজিস্ট্রেট মহোদয় তিনটা ঘন্টা আতঙ্কে আর টেনশনে পর্যদুস্ত কাক ভেজা, কান্নারত একটা ছেলের জীবনের ডিসিশন নিয়ে নিলেন এক সেকেন্ড দেরি না করে।
সাধারনত দেরি করে হলে ঢুকলে আশঙ্কা করা হয় পরিক্ষার্থী সামহাউ নৈর্ব্যক্তিকের এন্সার জেনে এসে হলে ঢুকেছে। এই আশঙ্কা অমূলক তা না। বাট আমার স্টুডেন্টটা কতোটা ভালো স্টুডেন্ট, কতোটা শুদ্ধতম মানুষ আমি জানি। পরীক্ষার খাতায় কাটাকাটি হলে যে ছেলে আতঙ্কে পড়ে যায়, অংক না মিললে প্যানিক এটাক হয় সে ছেলে এসবে জড়িত হবার প্রশ্ন কতোবড় অলীক চিন্তা আমি জানি।
যাহোক, এসব গার্ডের টিচার কিংবা প্রিন্সিপালদের জানার কথা নয়। কিন্তু চোখের সামনে একটা ছেলে ভেজা জামাকাপড় গায়ে এই বয়েসে এতোগুলো মানুষের সামনে দাড়িয়ে অসহায় কান্না করছে, ওর চোখের দিকে তাকালেই তো ভাই বোঝার কথা সে দু নম্বরি করতে দেরি করেছে নাকি রাস্তার জ্যামের ঘটনা সত্য! এটুক কমনসেন্স, বোধ তো একটা প্রিন্সিপলের থাকার কথা। সারাজীবন ছাত্র চড়িয়ে পেট চালানো লোকের তো মূহুর্তেই বোঝার কথা কোন ছাত্রটা অভিনয় করছে আর কোনটা অসহায় কান্না করছে এবং বুঝেছে তারা অবশ্যই।
আসল ব্যাপার হলো, দে জাস্ট ডোন্ট কেয়ার। তারা চাইলেই ছেলেটাকে দশ মিনিটের জন্য MCQ প্রশ্নটা দিতে পারতো। ও ইভেন কাদতে কাদতে বলেছিলো এন্সার শীটটা অন্তত দিতে, ও প্রশ্ন না দেখে আন্দাজে কতগুলা দাগায় দিলেও যদি চারটা(পাশ মার্ক) নৈর্ব্যক্তিক হয়!
প্রিন্সিপল দায়সারা জবাব দিয়েছিলো, “আরে সৃজনশীল তো ভালো দিছো, পাশ করে যাবা সমস্যা নাই”। অথচ সবাই ভালো করেই জানে সৃজনশীল আর নৈর্ব্যক্তিকে আলাদা আলাদা পাশমার্ক উঠাতে হয়। এমন রেকলেস দায়সারা নিচুমানের মিথ্যে সান্তনা একটা কলেজের প্রিন্সিপল কিভাবে দিতে পারে? সন্দেহপূর্ণ কেইসে আইনের একটা ফান্ডামেন্টাল নিয়ম হলো, একটা দোষী কোন শাস্তি না পাক সমস্যা নেই, একটা নিরপরাধ যেনো কোনোভাবেই শাস্তি না পায়।
স্যারেরা যদি মনে করেনও ছেলেটা দু নম্বরি করতে গিয়ে দেরি করেছে, এতো কাকুতি মিনতি কি ওর নিরপরাধ হবার এক পার্সেন্ট সম্ভাবনাও জাগায় নি? একবারও মাথায় আনেনি ছেলেটা যদি সত্যই জ্যামের ভাগ্যে পড়ে দেরি করে থাকে তাহলে কতো বড় ইনজাস্টিস আমরা করছি?
আগেই বলেছি তারা আসলে কেয়ারই করে না। সরকারী কলেজের শিক্ষক। হাজার হাজার ছেলের মাঝে একটা দুইটা ফেইল করলে তাদের কিছুই আসে যায় না। হয়তো হরমামেশাই তাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এসব কোন মাথাব্যাথাই না।
এই ছেলের বাসায় আজ কান্নার রোল। মা বাবা সবার বুক ভেঙে গেছে এই ঘটনায়। ছেলেটা খাওয়া দাওয়া করছে না, চুপচাপ বসে আছে। পরের পরীক্ষাগুলো কেমন দেবে খোদাই জানে। ভালো স্টুডেন্টদের একটা বাজে পরীক্ষাই পরেরগুলোর মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আর ও বেচারা অলরেডি জেনে বসে আছে ওর আর পাশই আসছে না এইচ এস সি তে।
সেসময় ছোট্ট একটু মহানুভবতা যদি প্রিন্সিপল দেখাতো, একটু গুরুত্ব যদি দিতো, ছেলেটার চোখের পানিকে একটু যদি কনসিডার করতো তাহলে একটা ফ্যামিলির আজকের দিনটা এমন নরক হওয়া লাগতো না। রুলস আর রুলস- এটা কোনো যৌক্তিক কথাই নয়। এক্সেপশন কেইস সবসময় থাকবে। নিয়মের ব্যতিক্রমও তখন কর্তাব্যক্তিদের দেখাতে হবে। সবকিছুর উর্ধ্বে হলো বিপদে আপদে মানুষের প্রতি মানুষের দয়া, সহমর্মিতা, ইন্সট্যান্ট সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা। এসবকে কবর দিয়ে শুধু নিয়ম আউড়ে গেলে তাকে কতোটুকু অনুভূতিগ্রাহ্য মানুষ বলা যায়?
এদেশের রাস্তা ঘাটের প্রতি দোষ দিয়ে আর কি লাভ। জন্মই হলো জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ এদেশে। সেখানে রাস্তায় জ্যামের দুর্ভাগ্য নিয়ে কথা বলা শুধুই বাতুলতা। এদেশে থাকলে, এদেশে বাচলে এমন বিপদে বারবার, বারংবার পড়তে হবে। এটাই স্বাভাবিক। শুধুমাত্র আশা এটুকই- যখন নষ্ট রাজনীতি আর দুর্নিতিগ্রস্থ এই দেশের সিস্টেমের কবলে আটকে যাবো, তখন আশেপাশের মানুষগুলো যেনো একটু মমতা, একটু মানবতা দেখিয়ে অসহায়ের হাতটা ধরে। অসহায় বিপদে যদি সেটাও না পাওয়া যায় তাহলে বিশ কোটি মানুষের দেশ এটা- শুধু সাধারন জ্ঞানের প্রশ্ন হয়েই থাকবে।
এই ছেলেটার কপালে সেই মানবিকতাটুকুও জুটলো না। একজন জাতির মেরুদন্ড রুলস এন্ড রেগুলেশনের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ছেলেটার একটা বছর নষ্ট করে দিলো। খুব নিয়মনিষ্ঠ হওয়া হইলো, আইনের মান্য করা হইলো। শুধু মানবিকটাই হওয়া হইলো না। শুধু উচ্চশিক্ষিত হলে, রুচিশীল হলেই মানুষের প্রতি মানুষের মমতাবোধ জাগ্রত হয়না। বাস ভর্তি যাত্রী, ড্রাইভাররা যে মমতা ছেলেটার প্রতি দেখিয়েছে তার সিকিভাগ যদি প্রিন্সিপাল কিংবা মেজিস্ট্রেট দেখাতো তাহলে ছেলেটার জীবন থেকে একটা বছর নষ্ট হতো না।
[ আকাশ আব্দুল্লাহ হৃদয় – এর ফেইসবুক থেকে ]