মসলিন ‘ঢাকাই মসলিন’ নামে বিশ্বব্যাপী খ্যাত সূতিবস্ত্র। ঢাকা শহর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় স্থানীয় কারিগরদের দ্বারা স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন সুতা থেকে এই মসলিন তৈরি হতো।
‘মসলিন’ শব্দের উৎপত্তির উৎস অস্পষ্ট। কেউ বলেন, মসলিন শব্দটি ইরাকের একটি প্রাচীন ব্যবসাকেন্দ্র মসুল থেকে উদ্ভূত।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, দক্ষিণ ভারতে ইউরোপীয় বাণিজ্যিক কোম্পানির এককালের সদর দপ্তর মসলিপট্টমের সঙ্গে মসলিন শব্দটি সম্পৃক্ত। মসলিন ফার্সি, সংস্কৃত বা বাংলা শব্দ নয়। সম্ভবত ইউরোপীয়রা মসুল থেকে যেসব বস্ত্র আমদানি করত এবং প্রাচ্যের অপরাপর দেশ থেকে মসুল হয়ে যেসব বস্ত্র আনা হতো তারা তার নাম দেন মসলিন।
ঢাকার সূক্ষ্মবস্ত্র দেখে তারা সে বস্ত্রেরও নাম করেন মসলিন। মসলিন নামটি যে ইউরোপীয়দের দেওয়া সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। কেবল ঢাকার সূক্ষ্মবস্ত্রকেই মসলিন বলা হতো না, গুজরাট, গোলকুন্ডা ও ভারতের অন্যান্য স্থান থেকে ইউরোপীয়দের আমদানিকৃত যে কোন সূতিবস্ত্রকেই মসলিন নামে অভিহিত করা হতো।
অতীতে মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত মসলিনের গুণগান। মসলিন সম্পর্কে বলা হতো, আংটির ভেতর দিয়ে একটি শাড়িকে এপার-ওপার করা যেত। বিশ্বজুড়ে ছিল মসলিনের সুনাম এবং ব্যাপক চাহিদা। সে সব এখন অতীত। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর চাপে এখানকার মসলিন কারিগররা শাড়ি তৈরি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এখন আবার শোনা যাচ্ছে মসলিনের আগমনের কথা।
মসলিন কাপড় বোনার জন্য হাত নরম রাখতে হত
সাধারণ পোশাক তৈরিতে প্রচুর রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োজন হয়। এ সব প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ সবের বর্জ্য পানি পার্শ্ববর্তী জলাশয়ে মিশে পরিবেশের ক্ষতি করছে। ক্ষতি হচ্ছে জীববৈচিত্র্যেরও। কল-কারখানার রাসায়নিক পদার্থ উন্মুক্ত জমিতে পড়ে মাটি অনুর্বর হচ্ছে। কিন্তু মসলিন তৈরিতে ব্যবহার করা হতো শিমুল তুলা, উন্নত কার্পাসসহ আরও অনেক ধরনের প্রাকৃতিক তন্তু। এ তন্তুর দাম সাধারণ তন্তুর চেয়ে বেশি। তা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি মসৃণও।
জানা যায়, যে কার্পাস দিয়ে উন্নত মসলিন কাপড় তৈরি করা হয় তার নাম ফুটি কার্পাস। এর আবাদ বেশি হয় ভারতে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানিয়েছেন, আমাদের দেশ থেকে ধীরে ধীরে ফুটি কার্পাস হারিয়ে যেতে থাকে ব্রিটিশ আমলের শেষভাগে। এ গাছের চাষ হতে দেখা যেত আমাদের মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা পাড়ে। তবে বিখ্যাত ছিল শ্রীরামপুর, রাজনগর, কেদাপুরসহ বিভিন্ন স্থান। এক সময়ে গাজীপুরের কাপাসিয়া অঞ্চলে প্রচুর কার্পাস হতো। যে কারণে ওই স্থানের নাম হয়েছে কাপাসিয়া। মসলিনের তন্তু চাষ হতো সোনারগাঁয়ে, এ ছাড়া ঢাকা, ধামরাই, কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি আর বাজিতপুরেও হতো তন্তুর চাষ।
জামদানি, ইলিশ, চাপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাতি আমের পরে চতুর্থ পণ্য হিসেবে জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে স্বীকৃতি পেলো মসলিন! এখন থেকে মসলিন শুধুই আমাদের। মসলিনের পুনর্জন্ম ঘটাতে ছয় বছর ধরে লেগে ছিলেন একদল গবেষক। অবশেষে তারা সফলও হয়েছেন। কী বিচিত্র উপায়ে সংগ্রহ করা হলো মিহি মসলিনের উপাদানগুলো, তা একেকটা গল্পই বটে।
ঢাকাই মসলিনের শেষ প্রদর্শনী হয়েছিল লন্ডনে ১৮৫০ সালে। এর ১৭০ বছর পরে বাংলাদেশে আবার বোনা হলো সেই ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন কাপড়ের শাড়ি। ঠিক সে রকমই, যেমনটি বলা হতো- আংটির ভেতর দিয়ে গলে যায় আস্ত একটি শাড়ি। ইতিমধ্যেই ঢাকাই মসলিনের জিআই স্বত্বের অনুমোদন পাওয়া গেছে। ২৮ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। সূক্ষ্ম সুতায় তাঁতে বোনা হয় এই কাপড়।
শুরুটা হয় ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় মসলিন সুতা তৈরি হতো, তা জেনে সে প্রযুক্তি উদ্ধারের নির্দেশনা দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়।কমিটির অন্যান্য সদস্য হচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহ আলীমুজ্জামান, বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত পরিচালক মো.আখতারুজ্জামান, বিটিএমসি ঢাকার মহাব্যবস্থাপক মাহবুব-উল-আলম, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের উপমহাব্যবস্থাপক এ এস এম গোলাম মোস্তফা ও সদস্যসচিব করা হয় তাঁত বোর্ডের জ্যেষ্ঠ ইনস্ট্রাক্টর মো. মঞ্জুরুল ইসলামকে।
পরে গবেষণাকাজের স্বার্থে আরও সাত সদস্যকে এই কমিটিতে যুক্ত করা হয়। তারা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বুলবন ওসমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম ফিরোজ আলম, অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড অ্যাগ্রিল বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আইয়ুব আলী ও বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রাজশাহীর গবেষণা কর্মকর্তা মো. আবদুল আলিম।
এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেনকে। আর প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত হন বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আয়ুব আলী।
নারীদের হাতে এই কাপড় বোনা সবচেয়ে ভালো হয়
কাজের শুরুতে মসলিন কাপড় বা তুলার কোনো নমুনাই গবেষকদের কাছে ছিল না। তাদের প্রথম কাজ ছিল যে তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, সেই তুলার গাছ খুঁজে বের করা। সেই গাছটি আসল ফুটি কার্পাস কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার মসলিন কাপড়ের প্রয়োজন ছিল। এই দুটি জিনিস জোগাড় করাই এই প্রকল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।
প্রথমে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক ও লংদু বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে মোট ৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করেন। নমুনা হিসেবে নেয়া হয় গাছের তুলা, বীজ, পাতা, কাণ্ড ও ফুল। গবেষকেরা কাপাসিয়ার একটি গাছের জাতের সঙ্গে স্কেচের (আঁকা ছবির) মিল পান। সম্ভাব্য ফুটি কার্পাসের এই জাতটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের নিজস্ব মাঠে ও আইবিএসসির মাঠে চাষ করা হয়। গবেষক দল নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে ৩০০ বছর আগের শাড়িও পেয়েছেন। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তা আসলে পুরোনো সিল্কের কাপড়।
তবে এই গবেষণায় অনেক তথ্যই তাদের হাতের নাগালের বাইরে ছিল। দেশের অন্য কোনো উৎস থেকে মসলিনের নমুনা না পেয়ে তারা জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দেন। গবেষকদের দরকার ছিল চার বাই চার ইঞ্চির এক টুকরো ঢাকাই মসলিন কাপড়। কিন্তু কিছুতেই তাদের নমুনা দিচ্ছিল না জাদুঘর।
এমনকি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে আসার পরেও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের মসলিনের নমুনা দেয়নি। গবেষক দলটি জাতীয় জাদুঘরের নমুনার আশায় প্রায় আট মাস পার করে ফেলেন। একপর্যায়ে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য তারা ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কলকাতায় যান। এই মিউজিয়ামের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মুর্শিদাবাদে এখন যে মসলিন শাড়ি তৈরি হচ্ছে, তা দক্ষিণ ভারতে উৎপাদিত তুলা থেকে করা হয়, যা ঢাকাই মসলিনের মতো মোলায়েম নয়।
তাদের মতে, ঢাকাই মসলিন তৈরি করতে হলে ঢাকার আশপাশ থেকে জাত খুঁজে বের করে সেই তুলা দিয়ে সেই এলাকাতেই করতে হবে। মসলিন তৈরিতে তুলার জাত এবং আবহাওয়ার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। চাইলেই যেখানে–সেখানে ঢাকাই মসলিনের মতো শাড়ি তৈরি করা যাবে না।
ভারতে গিয়ে বিফল হয়ে গবেষক দল হতাশ হয়ে পড়েন। অধ্যাপক মনজুর হোসেন বলেন, এই খবর শুনে প্রধানমন্ত্রী তাদের লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যেতে বলেন। তিনি সেখানে ঢাকাই মসলিন দেখে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত মসলিনের একটু নমুনার জন্য ২০১৭ সালের জুলাইয়ে কমিটির তিন সদস্যসহ চার সদস্যের একটি দল লন্ডনের ওই মিউজিয়ামে যান। সেখানে মসলিনের কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য–উপাত্ত তারা পেয়ে যান।
লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করা হয়। গবেষকেরা এই মসলিনের ডিএনএর সঙ্গে আগে সংগৃহীত কাপাসিয়ার একটি জাতের ফুটি কার্পাস গাছের মিল পেলেন অবশেষে। তারা নিশ্চিত হন, সেটিই তাদের কাঙ্ক্ষিত জাতের ‘ফুটি কার্পাস’। স্থানীয় আবদুল আজিজ নামের এক ব্যক্তি এই কার্পাসের সন্ধান দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে এই কমিটির পক্ষ থেকে তাকে একটি মোবাইল ফোন উপহার দেয়া হয়। অবশেষে জাদুঘরে ঢোকার অনুমতি পান। সেখানে শুধু একটি পাগড়ি ঢাকাই মসলিনের তৈরি।