সুয়েজ খাল: ইতিহাস ও কিছু তথ্য
মিশরের সিনাই উপদ্বীপে মরুভূমির বালি খনন করে সুয়েজ খাল খনন করা হয়েছে। শুরুতে সুয়েজ খালের দৈর্ঘ্য ছিল ১৬৪ কি.মি, এবং গভীরতা ছিল ৮ মি.। বেশ কিছু সংস্কার ও সম্প্রসারণের পর ২০১০ সালের হিসাবমতে এর দৈর্ঘ্য ১৯০.৩ কি.মি এবং গভীরতা ২৪ মি. এবং সর্বনিম্ন সরুস্থানে এর প্রস্থ ২০৫ মি.। খালটি মিশরের সুয়েজ ক্যানেল অথরিটির মালিকানাধীন।
সুয়েজ খালের অবস্থান:
প্রায় ১৫০ ধরে ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন রক্ষা করে চলছে সুয়েজ খাল। এখানে পৃথিবীর এক অন্যতম অভূতপূর্ব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায়। বিশাল আকারের বহু সামুদ্রিক জাহাজ ভেসে চলে সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে। সুয়েজ খাল তৈরী হবার পর ইউরোপ ও ভারতের মাঝে সমুদ্রপথের দূরত্ব প্রায় ৭০০০ কি.মি কমে যায়। বর্তমানে সারা বিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ সমুদ্র বাণিজ্য শুধুমাত্র সুয়েজ খালের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সুয়েজ খাল তৈরীর আগে কোন জাহাজকে ইউরোপ থেকে দক্ষিণ এশিয়া আসতে হলে আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসতে হত। যার ফলে পৃথিবীর বড় বড় জাহাজ কোম্পানি গুলোকে জ্বালানির তেলের জন্য অনেক বেশি ব্যয় করতে হত। তাছাড়া নৌপথে পণ্য বহনকারী জাহাজগুলো ভারত মহাদেশ হতে ইউরোপে যেতে সময় লাগত প্রায় ৪০/৫০ দিন। তবে বর্তমানে মাত্র ২০ দিনে জাহাজ পৌঁছে যেতে পারে গন্তব্যে।
সুয়েজ খাল খননকার্য:
আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ১৯ শতকে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় সুয়েজ খালের মতোই একটি খাল ছিল। তৎকালীন মিশরের ফিরআউন প্রথম সেসট্রিস লোহিত সাগর হতে নীলনদ পর্যন্ত একটি খাল খনন করার নির্দেশ দেন। এরপর তার পরবর্তী ফিরআউনরা ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যে তৎকালীন নৌকা চলাচলের উপযোগী খাল খনন করেন। এই খাল প্রায় ১২০০ বছর সচল ছিল। কিন্তু খালটি শুধুমাত্র মিশরীয়রাই তাদের বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার করত। পরবর্তীতে এ খালের বেশ কিছু অংশ ভরাট হয়ে যায়, ফলে নৌকা ও অন্য যান চলাচল বাহ্যত হয়। খ্রীষ্টপূর্ব ৬ শতকে ফিরআউন নিকো পুনরায় এ খাল খনন করতে চায়। কিন্তু এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক অনাহারে মারা যায়। এর প্রায় ১০০ বছর পরে পারস্যের রাজা দারিউস ভূমধ্যসাগরের নিকটবর্তী অংশ খনন শুরু করেন। অতপর ২ শতাব্দী পরে দ্বিতীয় টনেমীর শাসনামলে এ খালের খনন কাজ সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে আবার মরুভূমির বালিধারা ভরাট হয়ে প্রায় ১০০০ বছর চাপা পড়েছিল খালটি।
বর্তমান সুয়েজ খালটিও টনেমীর আমলের সেই খালের আলোকে তৈরী করা হয়েছে। ১৪৯৮ সালে পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো দা গামা আফ্রিকা মহাদেশের কেপ অব গুডহপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে ভারতে আসার পথ আবিষ্কার করেন। ভাস্কো দা গামার আবিষ্কৃত পথে ইউরোপ হতে ভারতে আসতে সময় লাগত প্রায় ৪ মাস। এরপর প্রায় ৪০০ বছর ধরে ব্রিটিশ, ওলন্দাজ ও পর্তুগীজ জাহাজ এ সমুদ্রপথে রাজত্ব করে। কিন্তু সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে এসব আধুনিক জাহাজের ও অনেক সময় লাগত। তাই বাধ্য হয়ে ইউরোপের মনোযোগ যায় সুয়েজ উপকূলে। ভূমধ্যসাগর হতে লোহিত সাগরের উচ্চতা ১০ মি. বেশি থাকায় সে সময় খাল খননের চিন্তা বাদ দেয়া হয়।
তারপর ফার্দিনান্দ দে লেসেপ্স নামক একজন ফরাসি প্রকৌশলী এই খাল খননের উদ্যোগ নেন। সুয়েজ খাল খনন করতে ১৮৫৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর সুয়েজ খাল কোম্পানি গঠন করা হয়। লেসেপ্স চেয়েছিলেন সুয়েজ খাল কোম্পানি যেন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। তাই এ খাল প্রতিষ্ঠাকালীন চুক্তি অনুযায়ী সকল দেশ শান্তি ও যুদ্ধকালীন সময়ে বৈষম্যহীনভাবে চলাচল করতে পারবে।
কিন্তু তখন ব্রিটিশরা সুয়েজ খাল খননের বিরোধীতা শুরু করে। ব্রিটিশরা ভেবেছিল যেহেতু ফরাসিরা এ খাল খননের দায়িত্বে রয়েছে তাই তারা খাল খনন সম্পন্ন হবার পর পূর্ব শত্রুতার জের ধরে তাদের সুবিধা হতে বঞ্চিত করতে পারে। এছাড়াও ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের প্রতিষ্ঠিত রাজত্বে অন্য কোন ইউরোপীয় দেশকে ভাগ দিতে চাইনি। তাই খাল খনন যাতে বাঁধা প্রাপ্ত হয় সেজন্য ইউরোপের বিভিন্ন ব্যাংককে ব্রিটিশ সরকার অন্য দেশগুলোকে ঋণ দিতে নিষেধ করে। সে সময় মিশর ছিল ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। তৎকালীন মিশরের শাসক মুহাম্মদ সাঈদ পাশা ইউরোপের কিছু ব্যাংক হতে অতি উচ্চ সুদে ঋণ নিতে সক্ষম হন।
১৮৬৩ সালে মুহাম্মদ সাঈদের মৃত্যুর পর তার ভাতিজা ইসমাঈল পাশা মিশরের ক্ষমতায় আসেন। ১০ বছর ধরে খননের পর তার আমলেই খাল খননের কাজ সম্পন্ন হয়। পরবর্তী সময়ে এ খালের আরও বহু সংস্কার করা হয়। সর্বশেষ মিশরের সদ্য প্রয়াত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মদ মুরসি এ খাল খননের এবং সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন। কিন্তু অবৈধভাবে জেনারেল সিসির মাধ্যমে মিশরে সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত করা হয় ২০১৩ সালের ৩ জুলাই। আর তখন থেকে এখন পর্যন্ত নজরে পড়ার মতো কোন রকম উন্নয়ন করা হয়নি। একজন অন্যতম জনপ্রিয় দেশপ্রেমিক শাসক ড. মুরসিকে কারাগারে নানা রকম নির্যাতন করার ফলে অর্থনীতির চালিকাশক্তি সুয়েজ খালের উন্নয়ন থেমে যায়।