যাকাত ইসলামের তৃতীয় রুকন। সালাত ও যাকাতকে আল্লাহ তাআলা কুরআনে পাশাপাশি উল্লেখ করেছেন। এই ফরয বিধান পালন না করলে রয়েছে কঠিন আযাব। জমানো সম্পদ সাপ হয়ে কামড়াবে, রয়েছে আরও নানান শাস্তি। যাকাত আদায় মোটেও কঠিন কোনো চাপ নয়। সারা বছর খেয়ে-দেয়ে ইচ্ছেমতো খরচ করার পর যা অতিরিক্ত থাকবে, তার মাত্র ২.৫% যাকাত দেওয়া ফরয।
যাকাতের কয়েকটি মাসআলা:
১. কোনো মুসলিম যদি সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা বা সমপরিমাণ টাকার মালিক হন, আর তা যদি তার কাছে এক বছর থাকে, তাহলে তার উপর যাকাত ফরয।
২. যদি কারো কাছে সাড়ে সাত ভরির কম সোনা ও সাড়ে বায়ান্ন ভরির কম রুপা অথবা কিছু টাকা অথবা কিছু বাণিজ্যদ্রব্য আছে, যা একত্র করলে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্য বা তার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে তার যাকাত দিতে হবে।
৩. যে দিন নিসাবের সমপরিমাণ সম্পদের মালিক হবেন, সেদিন থেকে যাকাতের বছর শুরু হয়। এক বছর পর যাকাত আদায় করতে হয়। বছরের মাঝে কিছু সম্পদ বৃদ্ধি পেলে, নতুন প্রাপ্ত সম্পদ পুরাতন সম্পদের সঙ্গে যোগ হবে এবং পুরাতন সম্পদের বছর পূর্ণ হওয়ার পর সমুদয় সম্পদের যাকাত দিতে হবে। বছরের মাঝে যা যোগ হয়েছে তার জন্য পৃথক বছর পূর্ণ হওয়া লাগবে না।
যেমন: একজন লোক রামাদান মাসের এক তারিখে ৪২০০০ টাকার (৫২.৫ ভরি রুপার মূল্য) মালিক হয়েছেন। তাহলে তিনি সাহিবে নিসাব হলেন। বছর ঘুরে শা’বান মাসের শেষ দিনে যদি তিনি ঐ ৪২০০০ টাকা বা তার চেয়ে বেশি টাকার মালিক থাকেন, তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে। এখন মনে করুন, শা’বান মাসে বা রজব মাসে অথবা এরও আগে তার কাছে আরও ৫০০০০ টাকা এসে যোগ হয়। তাহলে তাকে মোট ৯২০০০ টাকা টাকার যাকাত আদায় করতে হবে।
৪. বছরের শুরু ও শেষে নিসাব পূর্ণ থাকলে যাকাত আদায় করতে হবে। মাঝে নিসাব কমে যাওয়া ধর্তব্য নয়। অবশ্য বছরের মাঝে সম্পূর্ণ সম্পদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে ঐ সময় থেকে নতুন করে বছরের হিসাব আরম্ভ হবে এবং এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর যাকাত আদায় করতে হবে। যাকাত হিসাবের ক্ষেত্রে চন্দ্রবর্ষ তথা আরবী তারিখ অনুযায়ী করতে হবে।
৫. যাকাতের বছর পূর্ণ হওয়ার আগে অর্থাৎ অগ্রিম যাকাত দেওয়া যাবে। কমবেশি হয়ে গেলে পরে সমন্বয় করে নেওয়া যাবে। একইভাবে কেউ চাইলে নির্ধারিত সময়ের পরেও যাকাত দিতে পারবেন। তবে ফরয কাজ দ্রুত সম্পন্ন করাই নিরাপদ।
৬. যাকাতযোগ্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে সোনা-রুপা, টাকা এবং ব্যবসার পণ্য। পালিত পশুর ক্ষেত্রেও নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী যাকাত ফরয হয়। সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলংকার ইত্যাদির উপর যাকাত ফরয নয়। তদ্রূপ হিরা, মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসাপণ্য না হলে সেগুলোতেও যাকাত ফরয নয়।
৭. সরকারি চাকুরিজীবীদের ভবিষ্যত তহবিলে জমাকৃত টাকাও যাকাতের আওতাভুক্ত, তবে বিষয়টি একটু ব্যতিক্রম। এই প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ এবং তার কর্তৃত্ব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের (সরকারের) হাতে। এতে চাকরিজীবীদের কর্তৃত্ব থাকে না, তাই তাতে তাৎক্ষণিকভাবে যাকাত ফরয হয় না। এই অর্থ যখন হাতে আসবে, তখন তার যাকাত দিতে হবে। এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বছরগুলোর যাকাত দিতে হবে না।
যে সব বেসরকারি কোম্পানীতে কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড একটি পৃথক বোর্ডের নিকট হস্তান্তর করা হয়, আর সে বোর্ডে কর্মচারীদের প্রতিনিধি থাকে। এই বোর্ড যেহেতু কর্মচারীদের উকিল বা প্রতিনিধি সেহেতু বোর্ড কর্তৃক ঐ অর্থ গ্রহণ করা মূলতঃ কর্মচারী কর্তৃক গ্রহণ করা। সুতরাং এ প্রকার প্রভিডেন্ট ফান্ডে যথানিয়মে প্রতি বছর যাকাত ফরয হবে।
ব্যাংক একাউন্টের টাকা, ডিপিএস, ফিক্সড ডিপোজিট , সঞ্চয়পত্র, প্রাইজবন্ড ইত্যাদিও যাকাতের হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হবে। । হজ্বের উদ্দেশ্যে কিংবা ঘর-বাড়ি নির্মাণ, বিয়ের খরচ ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হচ্ছে তা-ও যাকাতের মোট হিসাবে সংযুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ নিজের মালিকানায় থাকা সকল টাকা যাকাতের অন্তর্ভুক্ত।
৮. দোকান-পাটে যা কিছু বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে রাখা থাকে তা বাণিজ্য-দ্রব্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত আদায় করা ফরয।
ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক যেমন জমি-জমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর হোক, তা বাণিজ্য-দ্রব্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত দেওয়া ফরয হবে।
৯. ঘরে ব্যবহারের আসবাবপত্র যত উচ্চমূল্যেরই হোক না কেন, তাতে যাকাত ফরয নয়। তবে সেগুলোতে যদি সোনা-রুপা সংযুক্ত থাকে তাহলে অন্যান্য যাকাতযোগ্য সম্পদের সাথে এই সংযুক্ত সোনা-রুপারও যাকাত ফরয হবে।
১০. ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসাপণ্য নয়, তার ওপর যাকাত ফরয নয়। তবে ফার্নিচারের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে যেসব ফার্নিচার রাখা থাকে তা যেহেতু বাণিজ্যদ্রব্য তাই এসবের ওপর যাকাত ফরয হবে।
১১. ঘর-বাড়ি, ফ্ল্যাট বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও যাকাত ফরয নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা যাকাতযোগ্য মোট সম্পদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর ব্যবসার জন্য যে জমি বা বাড়ি ক্রয় করা হয়েছে, সে জমি বা বাড়ির মূল্যের যাকাত আদায় করতে হবে। অর্থাৎ যে জমি ক্রয় করা হয়েছে লাভে বিক্রির আশায়, সেই জমির মূল্য যাকাতের হিসাবের মধ্যে আসবে।
১২. কারো ঋণ যদি এত পরিমাণ হয় যা বাদ দিলে তার কাছে নিসাব পরিমাণ যাকাতযোগ্য সম্পদ থাকে না, তাহলে তার ওপর যাকাত ফরয নয়। এখানে স্মরণ রাখতে হবে, যে ঋণ প্রয়োজন পূরণের জন্য বাধ্য হয়ে নিতে হয়, সেই ঋণ উদ্দেশ্য। যেমন, কেউ বসবাসের জন্য ঘর তৈরি করতে যে ঋণ গ্রহণ করে বা যে কোনো বিপদে পড়ে ঋণ নেয়। এক্ষেত্রে যাকাত আদায় করার সময় ঋণের টাকা বাদ দিয়ে হিসাব করতে হবে।
উদাহরণ: একজনের কাছে পাঁচ লাখ টাকা আছে। তিনি আরেক জনের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। এখন তার যাকাতযোগ্য সম্পদ হচ্ছে (পাঁচ লাখ-দুই লাখ)=তিন লাখ টাকা। এই তিন লাখের ২.৫% যাকাত দিতে হবে।
তবে যে সকল ঋণ উন্নয়নের জন্য নেওয়া হয় যেমন কারখানা বানানো, কিংবা ভাড়া দেওয়া বা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে ভবন তৈরি করা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে যে ঋণ নেওয়া হয়, যাকাতের হিসাবের সময় সে ঋণ ধর্তব্য হবে না।
১৩. অন্যকে যে ঋণ দেওয়া হয়েছে বা ব্যবসায়ী কোনো পণ্য বাকিতে বিক্রয় করা হয়েছে, তাতেও যাকাত দিতে হবে। তবে পাওনা আদায় হওয়ার পর ওই টাকার যাকাত আদায় করা ফরয হয়। তার আগে আদায় করা জরুরি নয়, তবে আদায় করলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। পাওনা আদায় হতে যদি কয়েক বছর সময় অতিবাহিত হয়ে যায়, তাহলে আদায় হওয়ার পর বিগত সকল বছরের যাকাত আদায় করা ফরয হয়।
১৪. ব্যবসায়িক ফ্ল্যাট বা জমি ব্যতীত অন্যান্য জমি যথা বাড়ি বা খেতের জমির উপর যাকাত নেই। তবে তাতে উৎপাদিত ফসলের উপর যাকাত ফরয। সেই ফসল যদি বৃষ্টির পানিতে হয় এবং সেচের প্রয়োজন পড়ে না, তাহলে তার উশর অর্থাৎ উৎপাদিত ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। আর যদি সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করতে হয়, তাহলে তার নিসফুল উশর অর্থাৎ উৎপাদিত ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। ফসলের যাকাত আমাদের দেশে বেশি উপেক্ষিত। এদিকে সবাই গুরুত্বারোপ করা উচিত।
১৫. বাস-ট্রাক, সিএনজি,রিক্সা ইত্যাদি যেকোনো গাড়ির মালিকের ক্ষেত্রে গাড়ির মূল্যের উপর যাকাত ফরয নয়। ভাড়ায় চালিত হলে, ভাড়া বাবদ যত আয় হবে, কেবল তার যাকাত দিতে হবে। আর যে সব গাড়ি দোকানে বিক্রির জন্য রাখা হয়, সে সব গাড়ির মূল্যের উপর যাকাত ফরয। কেননা সেটা ব্যবসাপণ্য।
গ্রন্থপঞ্জি: ১. রদ্দুল মুহতার ২. ফাতাওয়া ও মাসাইল ৩. মাসিক আল কাউসার ৪. ফেকহী মাকালাত
যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে। যেন কোনো ক্রমেই পরিমাণের চেয়ে কম আদায় না হয়। মনগড়া/অনুমাননির্ভর হিসাব করবেন না। আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের তাওফিক দান করেন।
আমীন।
[ মোঃ মুহিবুর রহমান – এর ফেসবুক ওয়াল থেকে ]
বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)
প্রভাষক
মৌলভীবাজার সরকারি মহিলা কলেজ