শিক্ষাক্রম পাল্টে যাচ্ছে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। বিষয় ও পরীক্ষা কমিয়ে বইয়ে আনা হচ্ছে পরিবর্তন। প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা এক বছরের পরিবর্তে দুই বছর হবে। দশম শ্রেণির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না। একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক নাকি ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বে, সেটি ঠিক হবে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে, যা এখন নবম শ্রেণিতে হয়।
এভাবে দেশের প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাক্রমে বড় পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য বিদ্যমান শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করে নতুন শিক্ষাক্রম তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রম ২০২২ সাল থেকে বাস্তবায়ন শুরু হবে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় শিক্ষানীতি, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসহ (এসডিজি) বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম করা হচ্ছে। আগামী জানুয়ারি থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কথা থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে এক বছর পেছানো হয়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী আগামী জুনের মধ্যে নতুন বই প্রণয়নের কাজ শেষ করা হবে। এরপর ২০২২ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে নতুন বই দেওয়া শুরু হবে।
বিদ্যমান ও নতুন শিক্ষাক্রমের পার্থক্য কী?
এনসিটিবি সূত্রমতে, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সাধারণভাবে বলা হয়, একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সমন্বিতভাবে অর্জিত হলে তার যোগ্যতা গড়ে ওঠে। বিষয়টিকে উদাহরণ দিয়ে এনসিটিবি বলেছে, একজন শিক্ষার্থী একটি গাড়ি কীভাবে চালাতে হয়, তা যখন বই পড়ে বা শুনে বা দেখে জানতে পারে, তখন তার জ্ঞান অর্জিত হয়। ওই শিক্ষার্থী যদি গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্র হাতে-কলমে পরিচালনা করতে শেখে, অর্থাৎ সামনে, পেছনে, ডানে-বাঁয়ে চালাতে পারে, ব্রেক করতে পারে, তখন তার দক্ষতা তৈরি হয়। আর যদি ওই শিক্ষার্থী গাড়ি চালিয়ে নিজের ও রাস্তার সব মানুষ, প্রাণী ও সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষা করে গন্তব্যে পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জন করে, তখন তার গাড়ি চালনার বিষয়ে যোগ্যতা অর্জিত হয়।
প্রাক্-প্রাথমিক দুই বছর:
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা হবে দুই বছর মেয়াদি, যা চার বছর বয়সী শিশুদের দিয়ে শুরু করে ছয় বছর পর্যন্ত চলবে। প্রাক্-প্রাথমিকে দুটি শ্রেণি থাকবে। একটি হবে প্রাক্-প্রাথমিক প্রথম শ্রেণি এবং প্রাক্-প্রাথমিক দ্বিতীয় শ্রেণি। বর্তমানে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের এক বছর মেয়াদি প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়। আর ছয় বছরের বেশি বয়সী শিশুদের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, এ বিষয়ে ইতিমধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনুমোদন পাওয়া গেছে।
কমছে বিষয়:
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।
প্রাক্-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকেরা শেখাবেন। প্রাথমিকের জন্য আটটি বিষয় নির্বাচন করা হয়েছে। এগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। এর মধ্যে ‘ভালো থাকা’ এবং ‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বিষয়ে আলাদা বই থাকবে না। এগুলো শিক্ষকেরা শেখাবেন, যার জন্য নির্দেশনামূলক বই দেওয়া হবে।
আর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০টি অভিন্ন বই পড়ানো হবে। এগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। বর্তমানে মাধ্যমিকে ১২ থেকে ১৪টি বই পড়ানো হয়। এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কিছু অভিন্ন বই পড়তে হয়। আর নবম শ্রেণিতে শাখা বিভাজন হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শাখা পরিবর্তন হবে।
নতুন বই:
এনসিটিবির সূত্রমতে, প্রথম বছর (২০২২) প্রাক্-প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি, প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি বই পাবে। এর পরের বছর (২০২৩) অষ্টম শ্রেণি এবং ২০২৪ সালে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নতুন শিক্ষাক্রমের বই দেওয়া হবে। ২০২৬ সালে উচ্চমাধ্যমিকের বই দেওয়ার কথা।
পরীক্ষা ও মূল্যায়ন:
প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, তৃতীয় শ্রেণির আগে স্কুলে কোনো পরীক্ষা রাখা হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন হবে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন (বার্ষিক পরীক্ষা)। একইভাবে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬০ শতাংশ শিখনকালীন এবং ৪০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। নবম ও দশম শ্রেণিতে ৫০ শতাংশ শিখনকালীন ও ৫০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে।
দশম শ্রেণিতে গিয়ে হবে পাবলিক পরীক্ষা। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা হবে। দশম শ্রেণির মোট ১০টি বিষয়ের মধ্যে ৫টির পরীক্ষা হবে এসএসসিতে। এগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান। বাকি পাঁচটি বিষয়ের মূল্যায়ন হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা হয়। এখন গড়ে ৩২ কর্মদিবস লাগে এসএসসি পরীক্ষা নিতে। নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে পাঁচ কর্মদিবসেই পরীক্ষা শেষ হবে।
শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী, উচ্চমাধ্যমিকে (একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি) ৬টি বিষয়ে ১২টি পত্র থাকবে। একাদশ শ্রেণিতে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে বাংলা, ইংরেজি এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থী যে শাখায় পড়বে, সেই শাখার প্রতিটি বিষয়ের প্রথম পত্রের (মোট তিনটি) পরীক্ষা হবে। অর্থাৎ একাদশ শ্রেণিতে মোট ছয়টি বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা হবে। আর দ্বাদশ শ্রেণিতে নিজ নিজ শাখার তিনটি বিষয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পত্রের মোট ছয়টি বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রতি শাখার তিনটি বিষয়ের প্রতিটির জন্য তিনটি পত্র থাকবে। দুই পরীক্ষার সম্মিলিত ফলের ভিত্তিতে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল ঘোষণা হবে।
বর্তমানে এসএসসি ও এইচএসসি ছাড়াও পঞ্চম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী এবং অষ্টম শ্রেণি শেষে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে এসব পরীক্ষার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
সপ্তাহে ছুটি দুদিন, জাতীয় দিবসে খোলা:
বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি সাধারণত এক দিন (শুক্রবার)। নিজেদের সিদ্ধান্তে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান দুই দিনও ছুটি রাখে। নতুন শিক্ষাক্রমে সরকারি ছুটির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও শুক্র ও শনিবার ছুটি থাকবে। তবে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিবস, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, জাতীয় শোক দিবস এবং বিজয় দিবসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হবে। এই দিবসগুলোতে সব শিক্ষার্থীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসতে হবে, কিন্তু ক্লাস হবে না। দিবসের তাৎপর্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি থাকবে, যেগুলো ধারাবাহিক মূল্যায়নে যুক্ত হবে।