আরবী বিভাগে কেন পড়বো? আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে আরবির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিশ্বায়নের এই যুগে যোগাযোগের মাধ্যমে হিসেবে আরবিকে শীর্ষস্থানীয় ভাষাগুলোর একটি বিবেচনা করা হয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ ভাষার গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশের চারটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষা ও সাহিত্যকে গুরুত্বের সাথে পাঠদান করা হয়। আর এগুলো হলো যথাক্রমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও আলিয়া ও ক্বওমীয়া মাদরাসায় আরবি সাহিত্য ব্যাপকভাবে চর্চিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিইচ্ছুরা বিষয় পছন্দের তালিকায় আরবিকে প্রথম সারিতে রাখতে পারে; যার অনেকগুলো প্রধান কারণ রয়েছে। আরবি ভাষা ও সাহিত্যের গুরুত্বঃ আরবি ভাষা বর্তমান বিশ্বের আলজিরিয়া, বাহরাইন, চাঁদ, কমোরোস, জিবুতি, মিসর, ইরিত্রিয়া, ইরাক, ইসরাইল, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় ভাষা। এসব আরব দেশ ছাড়াও তুর্কি, মালয়েশিয়া ও সেনেগালে এ ভাষার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও কোরিয়ার মতো দেশ সমূহে আরবি সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজের মর্যাদা পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী অমুসলিম দেশ ভারতেও এ ভাষার চর্চা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বের ৪২২ মিলিয়ন আরব জনগোষ্ঠী এবং দেড় শ’ কোটিরও বেশি মুসলিম তাদের দৈনন্দিন জীবনে এ ভাষা ব্যবহার করেন। জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ওআইসিসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিসিয়াল ভাষা হলো এই আরবি। শুধু তা-ই নয়, ‘ট্রেড ল্যাংগুয়েজ’ হিসেবে এ ভাষা অনারব দেশেরও প্রায় প্রতিটি পণ্যের মোড়কে শোভা পায়। পণ্যের গুণগত মান ও বিজ্ঞাপন সংবলিত আরবি লেখা আমাদের দেশের দুই টাকার বিস্কুটের প্যাকেটেও লক্ষ করা যায়। এতে অতি সহজেই আমাদের কাছে আরবী ভাষার মর্যাদা, গুরুত্ব এবং এ ভাষাচর্চার প্রয়োজনীয়তা অনুমিত হয়। এছাড়াও বলা হয়ে থাকে, আরবি পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা। এ ভাষায় সাহিত্যরস, সাহিত্যসম্ভার ও সাহিত্যের উপাদান অন্য যেকোনো ভাষার চেয়ে অনেক উন্নত। ১৯৮৮ সালে মিশরীয় সাহিত্যিক নাজিব মাহফুজের নোবেল পুরস্কার লাভের মাধ্যমে এই সাহিত্য এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়। তাই আরবি ভাষা বাদ দিয়ে বিশ্বসাহিত্য হতে পারে না। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসও আরবি সাহিত্যের ইতিহাস ছাড়া রচিত হতে পারে না। তাছাড়া আরবি সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিবেচিত। তাই বাংলা সাহিত্যকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাতেও আরবী সাহিত্য চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। যে যে বিষয়ে পড়ানো হয়ঃ আরবি বিভাগ হচ্ছে মূলত ভাষা ও সাহিত্যের বিভাগ। এখানে শিক্ষার্থীদের বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় এবং সাহিত্যেকে ভালোভাবে রপ্ত করার জন্য উচ্চ সাহিত্যিক মানসম্পন্ন প্রাচীন ও আধুনিক আরবি কবিতা, ছোটগল্প, নাটক ও উপন্যাস পাঠদান করা হয়। আরবি ভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি সিলেবাসে রয়েছে কুরআন ও হাদীসের অংশবিশেষ। এছাড়াও তথ্য প্রযুক্তি, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস, অর্থনীতি, ইসলামী অর্থনীতি, বাংলাদেশ ও বিশ্ব রাজনীতি, মুসলিম আইন (ফিকহ), বাংলা, ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ের পড়াশোনা এখানে করানো হয় পেশাদারিত্বের খাতিরে। তাই মোটামুটি এসকল বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যাবে এই বিষয়ে পড়াশুনা করলে। আরবি বিভাগের চাকুরির ক্ষেত্রসমূহ- চাকুরির বাজারে এগিয়ে থাকতে হলে সর্বপ্রথম আপনার যা প্রয়োজন হবে তা হলো যোগ্যতা। আপনি যে বিষয়েই অনার্স করেন না কেন, আপনাকে ইংরেজি, গণিত, চাকুরি এবং আপনার সাবজেক্ট সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। আপনি যে বিষয়েই অনার্স শেষ করেন না কেন; যথাযথ যোগ্যতা ছাড়া কোন চাকুরিতে প্রবেশ করতে পারবেন না। নিন্মে আরবী বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য উল্লেখযোগ্য চাকুরির ক্ষেত্রসমূহ বর্নণা করা হলো- ১। বিসিএসঃ বিসিএস পরীক্ষায় কোন সাবজেক্ট দেখা হয় না। যেকোনো বিষয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারলেই বিসিএস দেওয়া যায়। শুধুমাত্র শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষেত্রে বিষয় দেখা হয়। আরবি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের জন্য বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার হওয়ারও সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের ৩টি সরকারি মাদরাসা এবং ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত অনেক কলেজেই আরবি বিভাগ রয়েছে যেখানে শুধুমাত্র আরবি বিভাগের ছাত্ররাই শিক্ষা ক্যাডার হিসেবে যোগদানের সুযোগ পাবে। ২। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকঃ নিজ বিভাগে ১ম স্থান অধিকার করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামস্থ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সহ কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয়। ভালো ফলাফল অর্জন করে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে পারবে শুধুমাত্র আরবী বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ৩। কলেজ এবং মাদরাসাঃ এমপিওভুক্ত কলেজ, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদরাসার আরবি প্রভাষক হিসেবে যোগদান করতে পারবে আরবী সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাদরাসা সমূহের আরবি প্রভাষক হিসেবে শুধুমাত্র আরবী বিভাগের শিক্ষার্থীরাই আবেদন করতে পারবে। ৪। ব্যাংক জবঃ ইসলামী ব্যাংকসমূহ এবং প্রচলিত সাধারণ ব্যাংকের ইসলামী শাখায় যোগদানের জন্য আরবী বিভাগের শিক্ষার্থীরা অগ্রাধিকার পাবে। ৫। শরীয়াহ সুপার ভাইজারি বোর্ড অব ইসলামী ব্যাংকসঃ বাংলাদেশে প্রায় ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক এবং প্রচলিত সাধারণ ব্যাংকগুলোতে ইসলামী শাখা রয়েছে। যাদের আলাদা সুপার ভাইজারি বোর্ড এবং একটি সেন্ট্রাল শরীয়াহ বোর্ড আছে; যার বর্তমান চেয়ারম্যান চবি আরবী বিভাগের প্রফেসর ড. গিয়াস উদ্দিন তালুকদার স্যার। এসব শরীয়াহ সুপার ভাইজারি বোর্ডে শুধুমাত্র আরবী বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। ৬। বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও আরব দূতাবাস সমূহে চাকুরির সুযোগঃ ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামী ফাউন্ডেশন এবং আরব দূতাবাস সমূহে শুধুমাত্র আরবি বিভাগের শিক্ষার্থীরাই চাকুরির সুযোগ পাবে। এছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় অনুবাদক ও দোভাষী হিসেবে কাজ করা সুযোগ রয়েছে। ৭। বিদেশে চাকুরিঃ আরবি ভাষা যেহেতু একটি আন্তর্জাতিক ভাষা তাই মধ্যপ্রাচ্যসহ আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশে আরবি জানা লোকের গুরুত্বও অনেক। তাই আরবি বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন উন্নত কর্মক্ষেত্র রয়েছে। যাদ্বারা দেশের প্রচুর রেমিটেন্স অর্জনের সুযোগ রয়েছে। ৮। অনুবাদকঃ কোন ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে হলে অন্য ভাষার সাহিত্য পাঠ ও অনুবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে প্রচুর আরবীয় গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ হচ্ছে। আরবী ভাষায় দক্ষ হলে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থায় সহজেই চাকুরি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ : এই বিষয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ব্যাপক উচ্চশিক্ষার সুযোগ। প্রতিবছরই সৌদি আরব, মিশর, কাতার ও তুর্কিসহ বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শুধুমাত্র আরবি বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। তাছাড়া অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ ও হার্ভার্ডসহ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগ রয়েছে। লেখক- এম. শামছুল আলম আরবী বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।