দেশের অর্থনীতিতে এসব কী ঘটছে
অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে প্রায় সব কটি প্রধান সূচক—রপ্তানি, প্রবাসী আয় ও আমদানিতে ঋণাত্মক প্রবণতার চিত্র তুলে ডেইলি স্টার বাংলার একটা ইনফোগ্রাফিকস ছিল, ‘ভালো নেই দেশের অর্থনীতি’। সেখানে মন্তব্যকারীদের একজন লিখেছেন, ‘ভালো নেই দেশের মানুষও’।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ কমছেই। আমদানি নিয়ন্ত্রণের পরও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, রিজার্ভ ২ হাজার ৯০ কোটি ডলার, তবে প্রকৃত রিজার্ভ ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের কম। গত ২ বছরে প্রতি মাসেই রিজার্ভ গড়ে ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার করে কমেছে (রিজার্ভ কমছেই, পতন ঠেকানো যাচ্ছে না, প্রথম আলো, ৫ অক্টোবর, ২০২৩)। সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন, মাত্র ২ মাসে ২০০ কোটি ডলার থেকে নেমে হয়েছে ১৩৪ কোটি ডলার। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় কমেছে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ, গত বছরের একই প্রান্তিকের তুলনায় কমেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এদিকে খেলাপি ঋণ মাত্র ৩ মাসে বেড়েছে প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা, ৬ মাসে ৩৫ হাজার কোটি।
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ২০২৩ সালের জুনের শেষে ৯৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের শুরুতে ২০০৯ সালের জুন মাসে ছিল ২৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ১৪ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ৩২২ শতাংশ বেড়েছে (নিউএজ, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩)। এসব ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় মাত্র দুই বছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ আড়াই বিলিয়ন ডলার থেকে সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণে জুলাই-আগস্টের মাত্র দুই মাসে ট্রেড ব্যালান্স-ঘাটতি এক বিলিয়ন ডলারে নামলেও ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট-ঘাটতি দুই বিলিয়ন ডলার হয়ে গেছে (বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট, মাসিক ডেটা)।
সরকারের কাছে অভ্যন্তরীণ জ্বালানি সরবরাহকারী, বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি, বিদেশি বিমান কোম্পানি, মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি, এলসি বিলম্বের দায়, বৈদেশিক ঋণের সুদ, বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জসহ বিভিন্ন বকেয়া জমা হয়েছে কয়েক বিলিয়ন ডলার। মুডিজ ও ফিচ বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দিয়েছে, এ অবস্থায় বিশেষ ঋণে দ্বিগুণের বেশি হলে ৫ শতাংশ সুদ চায় খোদ বিশ্বব্যাংক। বেসরকারি ঋণপ্রবাহ ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্নে (৯.৭৫%) পৌঁছেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলেছে, যান চলাচলে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর ঢাকা। বিশ্বের শীর্ষ ২০ ধীরগতির শহরের তালিকায় আছে ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, খুলনাও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
১ অক্টোবর প্রথম আলোকে এক সাক্ষাৎকারে ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেছেন, উন্নয়নের মডেল মিরাকল থেকে মরীচিকায় পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ‘উন্নয়ন-বিস্ময়’ কেন ‘উন্নয়ন-বিপর্যয়ের’ দিকে যাচ্ছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহিস্থ প্রভাব থাকলেও দায় মূলত সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভুল নীতির।
প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, জনসংখ্যা, মাথাপিছু আয় ইত্যাদি মৌলিক তথ্য নিয়ে লুকোচুরি; মূল্যস্ফীতি নির্ণয়ে সেকেলে পদ্ধতি, দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতির সময়ে নয়-ছয় সুদের হার চালু রাখা, ডলারের বিপরীতে টাকা অতিমূল্যায়িত রাখা, সংকটে কৃচ্ছ্র না চালিয়ে উল্টো নির্বাচন সামনে রেখে টাকা চাপিয়ে হাতির সমান আমলাতন্ত্র তোষণ—কোনটি রেখে কোনটির কথা বলা যায়। সরকার এক অর্থবছরে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে নিজেই মূল্যস্ফীতির সমস্যা উসকে দিয়েছে, (বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন ছাপানো রিজার্ভ মানি প্রবাহিত হয়ে এবং ব্যাংকঋণে গিয়ে বহুগুণে বাড়ে)। দলীয় প্রভাববলয়ের সুবিধাভোগীরা নীতি সংস্কারে সংকটের সমাধান হতে দিচ্ছে না!
বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ গলার কাঁটা হলেও সেসব ডলারে না দিয়ে স্থানীয় কোম্পানিকে চুক্তি রিভিউ করে টাকায় দেওয়ার কিংবা অযৌক্তিক হার বন্ধের উদ্যোগ নেই। মেয়াদ বাড়লে ঋণনির্ভর উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ও সুদের দায় বাড়ে। তা ছাড়া নিয়মিতভাবে একনেকে উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় উভয়ই বাড়ছে, এভাবে খোদ সরকারের ইচ্ছাতেই খোলা আছে দেশ থেকে ডলার পাচার বা চলে যাওয়ার প্রক্রিয়া। উন্নয়ন প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়নে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। উদ্যোগ নেই ডলার রক্ষার করতে বড় বড় খাতে সাশ্রয়ের, যেমন রিফাইনারি তৈরির, সার উৎপাদন বৃদ্ধির। সব নজর কিছু দৃশ্যমান প্রকল্পে।
প্রথম প্রান্তিক হিসেবে গত বছর থেকে আমদানি কমেছে ১৮ শতাংশ, কিন্তু খাতভিত্তিক ঋণপত্র খোলার হার অনেক বেশি কমেছে (ভোগ্যপণ্য ৩৯%, শিল্পের কাঁচামাল ২৮%, মূলধন যন্ত্রপাতি ২২%, জ্বালানি ও পেট্রোলিয়াম পণ্য ২২%)। অর্থাৎ আমদানির আড়ালে এখনো পাচার চলছে! এলসির মান নিয়ন্ত্রণের যথাযথ উদ্যোগ নেই!
গত তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে শ্রমিকের অভিবাসন চার গুণের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে, কিন্তু সৌদি থেকে রেমিট্যান্স কমেছে ১৭ শতাংশের বেশি। ডলারের বিপরীতে টাকা অতিমূল্যায়িত বলে হুন্ডি জনপ্রিয় হয়েছে। এলসির ওপর বিধিনিষেধ থাকায় হুন্ডির সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের স্ক্যামিং, জুয়া, বিদেশি হুন্ডি এজেন্ট দিয়ে ক্রিপ্টো কারেন্সির ব্যবসা, মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালান যুক্ত হওয়ায় হুন্ডির চাহিদা বেশি।
পাশাপাশি সস্তায় ব্যাংকঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে হুন্ডির স্থানীয় অর্থের জোগান দিয়ে পাচারের নতুন পদ্ধতির ফলে রেমিট্যান্সের ডলার পরোক্ষভাবে পাচার হচ্ছে হুন্ডিতে। গরিব মানুষকে সামান্য টাকা দিয়ে বা খাইয়ে বেনামে মোবাইল ব্যাংকিং খুলে হুন্ডি ও জুয়ার চক্র চলছে, নতুন ঝুঁকি ফাঁস হওয়া পাঁচ কোটি ভোটারের জাতীয় পরিচয়পত্র তথ্য। এ নিয়ে শুরু হতে পারে জাল এনআইডি, জাল সিম, জাল মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট, জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সের নতুন আয়োজন।
আগস্টে জুলাইয়ের চেয়ে ২১ শতাংশ রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, সেপ্টেম্বরে আরও সাড়ে ১৫ শতাংশ কমা চিন্তার বিষয়। কেননা, বিদেশগামী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছেই। বিএমইটির তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কর্মী বিদেশ গেলেও বার্ষিক রেমিট্যান্সের প্রবাহ ঢাকা বিভাগের মাত্র অর্ধেক! চট্টগ্রাম বিভাগে ইসলামি ধারার ব্যাংকের গ্রাহক বেশি। ব্যাংকের ওপর অনাস্থায় রেমিট্যান্স কমার প্রবণতাকে আচরণগত অর্থনীতির প্রতিষ্ঠিত নিয়ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।
হুন্ডির সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সংযোগ ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও এসব বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। এমএফএসের একমুখী ট্রানজেকশন ও বড় বড় অর্থ স্থানান্তর নজরদারিতে আনার, ওটিপি কোড চুরির তদন্তে কোনো উদ্যোগ নেই।
এদিকে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনের পরও ঢাকার যানজট কমেনি, বরং বেড়েছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে। তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি উঠেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা খরচের পরেও জলাবদ্ধতা কমেনি। অচল পাওয়া গেছে উচ্চ ক্ষমতার পাম্প, স্লুইসগেটও অকেজো (প্রথম আলো, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩)। কোথাও কেউ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে না। ছয় বছরে ছয় হাজার কোটি টাকা খরচ, তবু সামান্য বৃষ্টিতে ডুবছে চট্টগ্রাম শহর। ৮ হাজার কোটি টাকার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল প্রকল্প ১৮ হাজার কোটিতে পড়লেও বৃষ্টিজনিত জলাবদ্ধতায় উঁচুনিচু এবং আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমি সমীক্ষা, মাটি পরীক্ষা ও মাটির স্তর উন্নয়নে নয়-ছয় হয়েছে। এমন সমস্যা অধিকাংশ প্রকল্পেই।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এক মৌসুমে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু প্রায় ১৮ শতাংশ, (প্রথম আলো, ৩০ আগস্ট, ২০২৩)। বায়ুদূষণ রোধে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার তহবিল পাওয়ার পরও বাংলাদেশের বাতাসের গুণগত মান বছরের প্রায় অর্ধেক সময় অত্যন্ত দূষিতই থাকছে (৩০ সেপ্টেম্বর, ডেইলি স্টার বাংলা)।
জবাবদিহিহীনতার শীর্ষে পৌঁছেছে প্রশাসন! বিমান ক্রয়, সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়, মেগা প্রকল্প ঠিকাদারি বাইরে রেখেও টিআইবির হিসাবে ১১ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকার কার্যাদেশ হয়েছে প্রতিযোগিতাহীন (প্রথম আলো, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩)।
জনপ্রশাসনের পরিচালনা ব্যয় না কমানোয় সরকারের ওপর বাড়তি রাজস্ব আয়ের চাপ আছে, কিন্তু সেটা ধনীর আয়কর থেকে না তুলে আবারও নেওয়া হয়েছে ভুল পথ। আমদানিতে শুল্ক ও ভ্যাট বৃদ্ধি, সারের দাম দ্বিগুণ করা, জ্বালানি আমদানিতে ৩৩ শতাংশ শুল্ক, বেসরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিনিয়োগকৃত অর্থের লাভের ওপর ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ করারোপ ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি এবং যাপিত জীবনের সব বিষিয়ে তুলেছে।
খাদ্যবাজারে আগুন। বাজারে শর্করা, আমিষ কিংবা ভোজ্যতেলের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে গত দেড় বছরে। বেড়েছে পরিবহন ভাড়া, ওষুধের দাম, চলছে পুষ্টির হাহাকার। সমর্থন হারানোর ভয়ে সরকার সিন্ডিকেটকে ধরতে চায় না। রপ্তানি কমা, জ্বালানি ও মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানি কমা অর্থনীতিতে মন্দা ও বেকারত্ব বাড়ার বার্তা দিয়েছে। পোশাকশিল্পে নিম্নতম মজুরিতে গত পাঁচ বছরের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি সমন্বয় হয়নি, যৌক্তিক হারে মজুরি বাড়েনি বেসরকারি খাতে।
এদিকে নেই ভোটাধিকার, রাজনীতিতে চলছে অচলাবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞায় প্রশাসনে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। ইইউ পার্লামেন্টের প্রস্তাবে বাংলাদেশের জন্য ইইউর অবাধ বাজারসুবিধা ‘এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ)’ অব্যাহত রাখা যৌক্তিক কি না, সে প্রশ্ন স্পষ্টভাবে উঠেছে। সামনে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। সব মিলে দেশের অর্থনীতি ভালো নেই, ভালো নেই দেশ ও দেশের মানুষ! এ অবস্থায় বিবদমান নেতৃত্ব কি দায়িত্ব নিয়ে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করে সুশাসন ফিরিয়ে সংকট কাটাতে এগিয়ে আসবে?
লেখক:
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব
টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক, গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ।