খালেদ মুহিউদ্দীন: প্রধান, ডয়চে ভেলে বাংলা
দ্বাদশ নির্বাচনের সময় যতই এগিয়ে আসছে ততই আলোচনা তৈরি হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক না কি জাতীয় সরকার কেমন সরকার হবে- তা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ধারণা দিচ্ছে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তারই ধারাবাহিকতায় এবার ডয়চে ভেলেতে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে গণমাধ্যমটির বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ মুহিউদ্দীন।
বুধবার (১৮ অক্টোবর) ‘প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে গেলে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব’- এই শিরোনামে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে ডয়চে ভেলে বাংলা।
নিবন্ধে বলা হয়, ছুটিতে যাওয়ার আগে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য চার বা পাঁচজনকে গুরুত্বপূর্ণ সব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে টেকনোক্র্যাট মিনিস্টার নিয়োগ দিতে পারেন এবং মন্ত্রিসভার বাকি সব সদস্যকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করতে পারেন।
কয়েকজন বিচারক ও আইন বিশ্লেষকের সঙ্গে আলোচনা ও বাহাস করে এই উপসংহারে আসা গেছে, বর্তমান সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে না গিয়ে এ উপায়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কাছাকাছি যাওয়া যাবে।
নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে?
আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে শিগগিরই সংলাপ?
বিস্তারিত ব্যাখ্যার আগে একটু পাটাতন দেখে নেওয়া যাক। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়৷ যদিও আওয়ামী লীগের তরফে বলা হয়ে থাকে, সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের আদেশ দিয়েছিল বলেই জাতীয় সংসদ তা সংবিধান থেকে বিলোপ করেছিল, বাস্তবতা হলো আদালতের পুরো রায় প্রকাশের আগেই সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে। অর্থাৎ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদালতের রায়ের মাধ্যমে নয়, বরং সংসদের আইনের মাধ্যমে বিলোপ করা হয়েছিল।
পরে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে দেখা যায়, আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষণা করেছেন এই যুক্তিতে যে, গণতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের অপরিবর্তনীয় মৌলিক কাঠামো এবং এর প্রধান শর্ত হলো, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত থাকবে। উচ্চ আদালতের এই রায় মেনে নিয়েও বলা যায়, এই রায়ের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের প্রয়োজন ছিল না। বরং রায়ের নির্দেশনার ভিত্তিতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সংশোধন করা যেত। সাবেক প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য অনির্বাচিত উপদেষ্টার বদলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্য থেকে প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্যান্য উপদেষ্টা নিয়োগ করার বিধান করা হলেই তা উচ্চ আদালতের রায়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো।
কোনো সংশোধন না করে, সংবিধানের মধ্য থেকেই দলীয় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে নিচের প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে।
তপশিল ঘোষণার সাথে সাথে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তিন মাসের জন্য বা নির্বাচিত পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কার্যভার গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত ছুটিতে যাবেন এবং সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকবেন। এই সময়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কেউ থাকবেন না।
সংবিধানের ৫৪(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতির সময়ে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্পিকারের দায়িত্ব পালনের কথা বলা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে থাকলে বা অনুপস্থিত থাকলে কেউ ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হবেন- এমন কথা কোথাও বলা নেই। সুতরাং, কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তিন মাসের জন্য ছুটিতে যেতে সংবিধানে বাধা নেই।
ছুটিতে যাওয়ার আগে চার বা পাঁচজন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেবেন। সংবিধানের ৫৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মন্ত্রিসভার এক দশমাংশ সদস্যকে টেকনোক্র্যাট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায়। বর্তমান মন্ত্রিসভায় ৪৪ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী আছেন।
চার টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীকে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, আইন ও বিচার, প্রতিরক্ষা, তথ্য, পররাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়সহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত ১৬ থেকে ২০টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হবে। এরূপ দায়িত্ব বণ্টনের একক এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে। বিদ্যমান মন্ত্রিসভার বাকি সব বা অধিকাংশ সদস্যকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর ছুটিতে যাওয়া এবং টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের হাতে প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নিকট দায়বদ্ধ সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই এনএসআই ইত্যাদিও প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর অধীনে দেওয়া হবে। এই সংস্থাগুলোর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অফিস আদেশেই এটি করা সম্ভব।
নির্বাচন শেষ হওয়ার পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ছুটি শেষ করে শুধু নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের জন্য কাজে যোগ দেবেন এবং দায়িত্ব হস্তান্তরের পর বিদায় নেবেন। আর তিনি আবার সরকার গঠন করার ম্যান্ডেট পেলে নতুন শপথ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন।
এ সরকারকে নির্বাচনকালীন সরকার বলা যেতে পারে। প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করতে সংবিধানের কোনো সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে উচ্চ আদালতের রায় বাধা হবে না।
সূত্র: ডয়চে ভেলে