করোনা মহামারির এই সময়ে সারা বিশ্বজুড়ে নানান সংকটে দিনযাপন করছে মানুষ। অর্থনৈতিক সমস্যা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। মানুষ বেকার হয়ে যাচ্ছে। তবুও থেমে নেই চাহিদা, প্রত্যাশা ও উত্তরণের প্রচেষ্টা।
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি নিয়ে আজ কিছু কথা তুলে ধরা যাক। আমি ২০১৭ সালে চীনে এসেছি। তখন থেকেই চীনাদের কিছু বৈশিষ্ট্য আমাকে খুব বেশি প্রভাবিত করে। যেগুলো উল্লেখ করার মত তা হল:
১। কঠোর পরিশ্রম: রাতে আগেভাগে ঘুমাতে যাওয়া এবং সকালেই উঠে নাস্তা করে কাজে নেমে পড়া চীনাদের অন্যতম প্রধাণ বৈশিষ্ট। আমি দেখেছি তারা অকারণে রাত জাগে না। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে। কোন কাজ শুরু করলে সেটাতে সফল না হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকা এবং নিরন্তর খেটে যাওয়ার ক্ষেত্রে এরা অন্যতম।
এখন যে সম্পদ আছে তা দিয়ে কিছুদিন চলি, কোন কাজ না করেই দিন পার করি এ ধরণের কোন চিন্তা বেশিরভাগ করে না। যখন যেখানে যে সুযোগ কাজে লাগানো যায়, তাই কাজে লাগাই তারা। কোন কাজ একা করতে না পারলে একাধিক মানুষ একত্রে তা শুরু করে।
আমার গত সেমিস্টারের শিক্ষক মি. ফং ছি গুঅ শিক্ষকতার পাশাপাশি উনার বন্ধুদের নিয়ে নিজেই একটা মেনুফেকচারিং কোম্পানি দিয়েছেন। কি দরকার ছিল এত বেতন পেয়েও এমন উদ্যোগ নেয়ার, পরিশ্রম করার। অথচ বসে থাকা তাদের স্বভাব নয়।
আমাদের দেশের মানুষেরাও নিরলস পরিশ্রম করতে পারে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে না পারা এবং নতুন নতুন ধারণার বিকাশ ঘটাতে না পারা বেকারত্বের অন্যতম কারণ হতে পারে।
২। সময়ের গুরুত্ব: পৃথিবীতে যে জাতি সময়কে যত বেশি গুরুত্ব দিয়েছে সে জাতি আজ তত বেশি উন্নতি সাধন করেছে। আমাদের শিক্ষকরা নির্দিষ্ট সময়ের ১০/১৫ মিনিট আগেই শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত হন। বিভিন্ন মিটিং, সেমিনার ও আয়োজন গুলোতে তাদেরকে দেখেছি কোন রকম বিলম্ব করে নি। একই সাথে একই সময়ে সবাই হাজির হয়ে যায়। এরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সবসময় কাজ করে।
আমার বন্ধু জিম্মিকে দেখেছি পড়াশোনার পাশাপাশি পানির বোতল হোস্টেল গুলোতে সরবরাহ করতে। বিনিময়ে সে মাত্র ১ আরএমবি করে পায়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কি দরকার ১ আরএমবিতে এত কঠিন কাজ করার! তার উত্তর ছিল তুমি কি মনে কর আমি টাকার জন্য এটা করি? না, অযথা বসে না থেকে কাজ করি, তাতে শরীরচর্চা তো হবে।
অথচ মাত্র ১ টাকার জন্য ১৮.৯ লিটারের পানির বোতল ঘাড়ে করে ১-৬ তলা পর্যন্ত উঠে। কোন এলিভেটর নেই, আছে পেশিশক্তি, মানসিক শক্তি, ধৈর্য্য ও নিরলসভাবে কাজ করার হিম্মত।
৩। পরিমিত পুষ্টিকর খাবার: চীনাদের খাবার আমি তেমন পছন্দ করি না, যদিও বেশিরভাগ বিদেশী তা পছন্দ করে না। কিন্তু এদের খাবারের বিশেষ কিছু নিয়ম আছে। যেমন এরা অধিক মাত্রায় মিষ্টি জাতীয় খাবার ব্যবহার করে না। দৈনিক খাবারের তালিকায় সামান্য ভাত এর সাথে কয়েক প্রকার শাক/সবজি থাকে। আমিষ জাতীয় খাবার তো প্রায়ই তালিকায় থাকে।
অনেকে হয়ত বলবেন, আমাদের দেশ অনেক গরিব। এতকিছু সামলানো কঠিন অথবা সবার সামর্থ্য নেই। দেখুন, চীনারা কত কষ্ট করে পাহাড় গুলোতে চাষ করে। বাড়ির সাথে/পাশে যেখানে সামান্য একটু খালি জায়গা আছে সেখানেই কিছু না কিছু চাষ করে। তাতে করে মাসের কয়েকদিনের খাবার তো জুটবে। এদের অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যে বিপ্লব তা সত্যিই অবাক করার মতো।
দৈনন্দিন জীবনে যা কিছু প্রয়োজন তা তারা নিজেরাই উৎপাদন করে। ফলে তাদের সার্বিক চাহিদার প্রায় বেশিরভাগই নিজেরাই সম্পন্ন করে। আর এ কারণেই তারা আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারা পেরেছে দুর্নীতি না করে অথবা একেবারে কমিয়ে একটি দেশ ও জাতির প্রয়োজন পূরণে সক্ষম হতে।
৪। পরিবেশ সংরক্ষণ: একদিন এক লোককে দেখলাম গাড়ি নিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ বিপরীত পাশে গাড়ি থামাল। একটা খালি বোতল ডাস্টবিনে ফেলবে, কিন্ত কি দরকার ছিল যেকোন স্থানে ফেলে দিলে কে বা কি করত! অবাক হলাম তখন, যখন তিনি গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ফেলছিলেন তখন বোতলটা ডাস্টবিনে না পড়ে রাস্তায় পড়ে যায়। সাথে সাথেই তিনি গাড়ি থেকে নেমে ওটা তুলে আবার ডাস্টবিনে রাখলেন। দেখুন, এ জাতি উন্নত হবে না কেন!
রংপুর মহানগরীতে একদিন রাস্তার পাশে এক বেকারীতে একটা বাটি দই খাওয়ার পর বাটিটা ফেলার ঝুড়ি পেলাম না। তাই মালিককে বিনয়ের সাথে বললাম এখানে একটা ঝুড়ি দিলে ভালো হত। উনি উত্তর দিলেন, ঝুড়ি নাকি দিয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ একদিন সরিয়ে দিয়েছে। এছাড়া সারা দেশজুড়ে রাস্তার পাশে, ভাগাড়ে বা ময়লার স্তুপ হতে যে দুর্গন্ধ সহ্য করতে হয় তা একেবারেই বিরক্তিকর এবং রোগ সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম। যে পরিমাণ ধুলাবালি আমাদের দেশে তা সত্যিই অসহ্য। পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশের সংরক্ষণ জরুরী।
৫। শিক্ষা: আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা নিম্নমানের তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে না ঘুড়লে বুঝা যাবে না। তবে আমাদের দেশেও অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভালো পড়ানো হয়। কিন্তু মুখস্ত বিদ্যার চাইতে গবেষণামূলক পড়াশোনা না বাড়ালে দেশ কোনদিন বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে না। বিসিএস শিক্ষার চাইতে গবেষণামূলক ডিগ্রী পদ্ধতি বাড়ানো দরকার।
আমার গ্রাজুয়েশন প্রজেক্ট শিক্ষিকার ৫ বছরের ছেলে কিন্ডারগার্টেনে পিএলসি, রোবটিক্স, মেকানিক্স নিয়ে পড়াশোনা করে। বুঝতে পারে বা না পারে তাদের ক্লাসে ধারণা তো দেয়া হয়। এই বয়সে সে ক্লাসে প্রেজেন্টেশন দেয়, যেমনই পারে না কেন অভ্যাস তো গড়ে তোলা হয়।
রংপুর পলিটেকনিকে পড়াশোনার সময় ওয়েল্ডিং করতে মাত্র অর্ধেকটা ইলেকট্রোড ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হত, কিন্তু এখানে কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। আমি আমার প্রিয় দেশকে অনেক ভালোবাসি, কোন ভাবে ছোট করা আমার কর্তব্য নয়। কিন্তু তথ্য ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং পরিবর্তন জরুরী।
সার্বিকভাবে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে হলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে উদ্যোগ নিতে হবে সুন্দর, সমৃদ্ধ, পরিবেশবান্ধব রাষ্ট্র গড়ার। সম্ভাবনাময় দেশটি পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দ্বাড়াবে এটাই প্রত্যাশা।