খালেদ লুব্বাদ এবং লামা নাজ্জাল নামে দুই ফিলিস্তিনির সাথে আনকারায় প্রায় দুই বছর একসাথে সিভিল সোসাইটিতে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। এরমাঝে খালেদ গাজায় আর লামা পশ্চিম তীরের বাসিন্দা, দুজনেই আনকারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করছে। খালিদ পিএইচডিতে গবেষণারত আর লামা মাস্টার্সে।
এ দুজনসহ অনেক ফিলিস্তিনের বন্ধুদের সাথে পশ্চিম তীর এবং গাজায় ফিলিস্তিনের জীবন এবং সংগ্রাম নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তবে বিশেষত এ দুজনকে নিয়ে একদিন আলাদাভাবে বসেছিলাম। তাদের গল্প শোনা এবং দু এলাকার লোকজনের জীবন প্রণালী সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ার জন্য। দীর্ঘ গল্প হল।
দুজনের বক্তব্যের সারমর্ম হল, গাজায় বড় ধরনের অবরোধ থাকলেও ভিতরে তারা খুব শান্তিতে থাকে কিংবা স্বাধীনভাবে বাচতে পারে। নিয়মিত ইসরাইল কর্তৃক হামলা, প্রতিরোধ লেগে আছে কিন্তু নিজেরা নিজেদের মতো করে বাচতে পারে। এর বিপরীতে পশ্চিম তীরে ইসরাইলের তেমন হামলা নেই কিন্তু এক বাড়ী থেকে আরেক বাড়ীতে যেতেও ইসরাইলের অনুমতি নিতে হয়।
লামা তুরস্কে আসে জর্ডান হয়ে। তার বাড়ী থেকে দশ কিলোমিটার পথ পৌছতে ৬ বার চেক পোস্টে পরতে হয় এবং গাড়ী পরিবর্তন করতে হয়। তাতে আনকারা থেকে জর্ডান পৌছতে তার সময় লাগে চার ঘন্টা আর ওখান থেকে বাড়ী যেতে ছোট্ট পথে সময় লাগে প্রায় একদিন। তারপরও নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করে ইসরাইলীরা।
জীবনের কোন স্বাধীনতা নেই। তাকে জীবন সম্পর্কে নানা বিষয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞাসা করার পর এ্টাই বুঝতে পারলাম তূলনামূলকভাবে তারা বেশী কষ্টে আছে। যেমন, পশ্চিম তীরে যেকোন ধরনের মিলনমেলা (বিয়ে, গায়ে হলুদ কিংবা সুন্নতে খাৎনা এমনকি বাসায় কিছু মেহমান আসলেও) আগে ইসরাইল প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয় এরপর বাস্তবায়ন করতে পারে।
তাদের দুজনের দীর্ঘ বক্তব্যের মাঝে একটা কথাই শুধু মনে হচ্ছিল, সংগ্রামই জীবন। পাশপাশি আরেকটি বাজে অভিজ্ঞতাও উল্লেখ করতে চাই। আমি পশ্চিমতীরের যতজন ছাত্রের সাথে তুরস্কে পরিচিত হয়েছি তাদের অধিকাংশকেই মুসলিম হিসেবে খুব আশানুরুপ পাইনি। এমনকি মসজিদে আকসা কিংবা ফিলিস্তিন নিয়ে আমরা যতটা আবেগ পোষণা করি সেই আবেগও পাইনি। এটা হতে পারে দীর্ঘদিন ইসরাইলের ভীতরে থাকার কারনে ঈমানী চেতনা মরে যাওয়া কিংবা গাজায় যতবেশী জিহাদী মনোভাব লোকজন পোষণ করার সুযোগ পায় তারা ততটা পায়না।
আমি চিন্তা করি গাজা কত ছোট্ট একটা এলাকা। আয়তনে হয়তো গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের আয়তনের সমান বা সামান্য একটু বড়। গাজার আয়তন ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার আর গাজীপুর সিটির আয়তন ৩৫৯ বর্গকিলোমিটার। অথচ তাবৎ পৃথিবীর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ঈমানী চেতনা থাকলে এত কম শক্তি নিয়েও স্বগৌরবে বাচা যায়।
ঐদিন আল জাজিরার একটি ডুকুমেন্টারী দেখছিলাম যেখানে দেখাচ্ছিল কিভাবে তারা ইজরাইলের পানির পাইপ কেটে রকেট তৈরী করছে। সরঞ্জামাদীরও কি অপ্রতুলতা। তারপরও তারা টিকে আছে।
এই ছোট্ট গাজার ভয়ে তটস্থ থাকে ইসরাইল। না জানি কি করে বসলো! অথচ সামরিক, অর্থনৈতিক, লবিং কোন সেক্টরে ভালো অবস্থায় নেই ইসরাইল! খালিদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
ইজরাইলতো ইচ্ছা করলে গাজা যেকোন সময় দখল করতে পারে, তাদের যে পরিমান অস্ত্র কিংবা উপকরণ আছে।
খালিদের উত্তর: “এত সহজ নয়। গাজা নিতে আসলে হাজার হাজার শহীদের লাশের উপর দিয়ে নিতে হবে। যা কোন দেশের জন্যই সহজ নয়”।
বললাম: পশ্চিম তীর।
বললো: পশ্চিম তীরতো নিয়েই নিছে। যেকোন সময় ঢুকতে পারে ওখানে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরী। গাজায় সারা দুনিয়া থেকে যে সহায়তা আসে তাও ইসরাইলের মাধ্যমে আসতে হয়। গাজার মুদ্রাও ইসরাইলের মুদ্রা। প্রায় সকল পণ্যই ইসরাইল থেকে আসে। স্বভাবতই তুরস্ক এখানে প্রচুর সহায়তা করে থাকে। শুধু সরকার নয় বরং সাধারণ মানুষও। এরদোয়ানের নেতৃত্বে তুরস্ক গাজায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা অবকাঠামো নির্মানে সহায়তা করছে।
খালিদের মতে, তুরস্কের ইসরাইলের সাথে মিনিমাম সম্পর্ক বজায় রাখার এটাও একটা কারন। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম: গাজার মানুষজন তুরস্ক সম্পর্কে কেমন ধারণা পোষণ করে। তার উত্তর হামাস এবং ইসলামপন্থী লোকজন মনে করে তুরস্ক তাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তবে ফাতাহ সমর্থিত লোকজন তা মনে করেনা। পরবর্তী প্রশ্নে খালিদ জানালো গাজায় হামাসের সমর্থন ৬০-৬৫% আর ফাতাহর ৩৫-৪০%।
আমার মনে হয় ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের বিষয়টি পুরো মুসলিম বিশ্বের উপর নির্ভর করছে। বিশেষত শুধু তুরস্ক নয় বরং আরব বিশ্বকেও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু আরব বিশ্বের দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যে ঘটনাগুলো সাম্প্রতিক সময়ে ঘটছে তা গাজার জনগনের ঈমানী চেতনার সাথে অনেকটা প্রতারনার সামিল। আমি আসলে জানিনা এর পরিণতি কোন দিকে যাবে।
তবে, আমার মনে হয়না আলোচনার টেবিলে এর কোন সমাধান আছে কিংবা আলোচনার টেবিলে ফিলিস্তিনের মজলুম জনগন সুবিচার পাবে। ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয়তোবা সামরিকই। নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একাডেমিক থিউরী এখানে একমত হবেনা।
কিন্তু, বাস্তবতা হলো কিছু বিষয় থিউরী দিয়ে নয় বরং বাস্তব পদক্ষেপ দিয়ে হতে হয়। ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য, দখলদার ইসরাইলকে থামানোর জন্য মিশরসহ আরব বিশ্বকে সক্রিয় হতে হবে। যদি মিশরসহ আরব বিশ্বের যেকোন দেশ সামরিক নিজেদের গদি ধরে রাখার জন্য ইসরাইলে প্রভু হিসেবে মেনে নেয় তবে সামনের দিনে তাদের দাস হয়ে থাকার জন্য এ দেশগুলোর জনগনকে চিন্তা করতে হবে। যদিও আরব বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর নেতারা ইতিমধ্যেই তাদের দাসত্ব গ্রহন করছে। এর পরিণতি ভয়ানক হতে পারে।
গাজার খালেদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান কি? তার উত্তরও একই রকম। ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়েই। এখানে আলোচনা করে কোন সমাধান হবেনা। কারন, আলোচনার টেবিলে মানলেও ইসরাইল এখানে ফিলিস্তিনিদের মেনে নেয়না। অসলো চুক্তিসহ আরো সেই শান্তিচুক্তিগুলো হয়েছে এতে আদতে ফিলিস্তিনবাসীরা কিছুই পায়নি।
খালেদকে জিজ্ঞাসা করলাম: দুই রাষ্ট্রের অবস্থান মেনে নেওয়ার বিষয়টি গাজার লোকজন কিভাবে দেখে কিংবা হামাস আসলে ভিতরে কি চিন্তা করে?
“হামাস সাময়িকভাবে তথা রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে হয়তো মেনে নিতে পারে। কিন্তু এ ধরনের কোন সমাধান হবে বলে মনে হয়না। কিংবা হলেও টিকবে না”।
তাহলে সমাধান কি?
খালেদের উত্তর: মুসলিশ দেশগুলোকে আমাদের বিষয়ে এক হতে হবে। শক্তিশালী হতে হবে। বিশেষত মিশরকে সবচেয়ে বেশী এগিয়ে আসতে হবে। কারন তারা আমাদের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী। এরপর তুরস্ক, ইরান এবং আরব রাষ্ট্রগুলো আমাদের বিষয়টি সমাধানের লক্ষ্যে ঐক্যমতে আসতে হবে এবং সর্বোচ্চ সহায়তা করতে হবে।
বললাম, সকল দেশগুলো যেভাবে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে, এর ভবিষ্যৎ কি?
বললো: বর্তমানে আসলে তুরস্ক, ইরান এবং কাতার ছাড়া কেউই গাজাকে সহায়তা করছেনা। ভবিষ্যতে যদি কেউ সহায়তা না করে তবে কি করার আছে। হয়তো গাজাবাসীকেই লড়ে যেতে হবে।
খালেদ দীর্ঘ সাক্ষাতকারে জানালো, গাজায় পানি, বিদ্যুৎসহ মানবিক নানা সংকট রয়েছে। বিশেষত ইসরাইল আসলে কিছুই সেখানে সরবরাহ করতে দিতে চায়না। যতটুকু দেয় তা বিশ্বের চাপে এবং নানা মুসলিম দেশের সহায়তা পাঠানোর ফলে।
সবমিলে, ফিলিস্তিন ইস্যুটা আসলে কঠিনতর হচ্ছে। আবারো এক সালাউদ্দিন আইয়্যুবীর অপেক্ষায় তারা দিন গুনছে। সেই সালাহউদ্দিন আইয়্যুবী যখন আসবে তখন তার নেতৃত্বে আবারো এই ফিলিস্তিন, মসজিদে আকসা মুসলমানদের হবে।
[ড. হাফিজুর রহমান-এর ফেইসবুক থেকে]