বিশ্বজুড়ে একটা মিথ ছড়িয়ে রয়েছে, বলা চলে সুকৌশলে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে; ‘ইহুদিরা জ্ঞানে বিজ্ঞানে, মেধা ও মননে অপ্রতিরোধ্য। তাদের সাথে বুদ্ধিতে, কৌশলে পারা যায় না, পারা সম্ভবপরও নয়।’ আমেরিকা, ফ্রান্স কিংবা ব্রিটেনের রাজনীতিতে তারা কতোটা শক্তিশালী ও প্রভাববিস্তাকারী, নোবেল লরিয়েট ও বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে তারা কতোটা এগিয়ে, তার তথ্য উপাত্ত দিয়ে সেই মিথকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
হিন্দু খৃষ্টান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কথা জানি না, কিন্তু এই মিথের সবচেয়ে বড়ো শিকার হতে হয়েছে মুসলিম যুব মানসকে। তারা যেন একপ্রকার হার মেনে বসে আছে আগে থেকেই। যেহেতু ইহুদিরে সাথে বিদ্যা বুদ্ধিতে পারা সম্ভবপর নয়, তাই ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থবিরোধি তাদের কর্মকান্ডকে রুখে দেবার কোন চেষ্টা প্রচেষ্টা আমাদের করার প্রয়োজন নেই, করেও কোন লাভ হবে না। এ যেন যুদ্ধে নামার আগেই আত্মসমর্পণ করা, হারার আগেই হার স্বীকার!
আমাদের বুঝতে হবে এটা একটা মনস্তাত্তিক যুদ্ধ। সারা বিশ্বজুড়ে নানা কলা কৌশলে যুদ্ধ চলে। সে যুদ্ধ কখনও চলে সাংস্কৃতির আবরণে, কখনও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অঙ্গনে, কখনোবা তথ্য প্রযুক্তির আবহে। ইদানিং, বলা চলে, বিগত একশত বসর বা তার কাছাকাছি সময়কাল ধরে এসবের সাথে আরও একটা অঙ্গন যুক্ত হয়েছে; সাইকোলোজিক্যাল বা মনস্তাত্তিক যুদ্ধ।
মনস্তাত্তিক যুদ্ধ মানব সভ্যতার সেই শুরু দিক থেকেই চলে আসছে। তবে বিগত এক বা দেড়শত বসর ধরে সেই যুদ্ধের ধরন ও ব্যাপকতা বিস্তৃত হয়েছে বহুগুনে বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি, তথা, মিডিয়ার বদৌলতে। এটা হলো ছায়াযুদ্ধ, সারা মুসলিম বিশ্বজুড়ে ইহুদিদের বিষয়ে এরকম ধারনা ছড়িয়ে দিয়ে মুসলিম যুবমনাসকে হতোদ্যম করে ফেলা হয়েছে। বস্তুত ইহুদিরা যে অজেয় কিংবা অপ্রতিরোধ্য, তার কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই।
এই অযৌক্তিক প্রচারণা ইদানিং মুসলিম দেশসমূহে জোরে শোরে প্রচার করা হচ্ছে। ফিলিস্তিন ও মুসলিম বিশ্বজুড়ে ইসরাইলের চলমান প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য কর্মকান্ডকে বাধাহীন করতেই মুসলিম যুবমানসকে অবশ, চেতনহাীন করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে।
কৌশলটি আগেও একবার অত্যন্ত সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল শরিফ হুসেইনের পুত্র যুবরাজ ফয়সলের ক্ষেত্রেও। সিরিয়ায় ১৯১৮ সালের জুন মাসে ডবরুসধহহ সফরে এলে ফয়সল তার সাথে যে গোপন বৈঠকটি করেন, সেই বৈঠকের আগেই কায়রোতে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার মোকমোহন (Sir Henry McMahon) ফয়সলকে ওয়াইজম্যান ও ইহুদিদের সন্মন্ধ্যে ব্রিফ করে লেখেন;
...this race, despised and weak, is universal and all powerful and cannot be put down. (বৈশ্বিক এ জাতিটা ঘৃণিত ও অসহায় হলেও তারা অত্যন্ত শক্তিশালী, তাদেরকে দাবিয়ে রাখা যায় না।)
এ মন্তব্ আমির ফয়সাল কতোটা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তা জানার কোন পথ আমাদের নেই। তবে বাস্তবে যেটা ঘটেছে সেটা আমরা জানি, সেটা হলো, লন্ডন ও প্যারিসে পরপর দুইবার গোপন বৈঠকের পর ১৯১৯ সালের ৩রা জানুয়ারি ফয়সল ও ইহুদি ওয়াইজম্যানের মধ্যে গোপন চুক্তির মাধ্যমে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে পূনর্বাসনের সূচনা হয়।
যে বিশ্বকে কুরআনের ধারক মুসলমানরা জ্ঞানে বিজ্ঞানে সাঁজিয়েছে, আজ সেই মুসলমানদেরকেই জ্ঞানের সবক নিতে হয় বিভ্রান্ত ও গজবপ্রাপ্ত বিপথগামীদের কাছ থেকে! এ লজ্জার পুরো দায়ভার জ্ঞানচর্চা বর্জনকারী মুসলমানদেরই।
নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তণ হয় উনবিংশ শতাব্দির একেবারে শেষের দিকে (১৮৯৫ খৃষ্টাব্দে)। প্রথম নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় ১৯০১ সালে। নোবেল পুরস্কারের রাজনৈতিক প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগের অভিযোগও নানা মহল থেকেই উঠে মাঝ মধ্যে।
বিশ্বের বুকে একটা সময় ছিল, তখন যদি নোবেল পুরস্কার প্রদানের কোন প্রথা থাকতো, তা হলে প্রতিটি পুরস্কারই পেতো মুসলিম বিজ্ঞানীরা। কথাটা আমার নয়, বলেছেন একজন ইসরাইলি ইহুদি অধ্যাপক ও পন্ডিত Martin Kramer তার Jerusalem Post পত্রিকার ৩০ শে ডিসেম্বর সংখ্যায়, তিনি লিখেছেন;
In the year 1000, the Middle East was the crucible of world civilization. One could not lay a claim to true learning if one did not know Arabic . . . An Islamic empire, established by conquest four centuries earlier, had spawned an Islamic civilization, maintained by the free will of the world’s most creative and enterprising spirits.... [T]here could be no doubt that the dynasties of Islam represented the political, military, and economic superpowers of the day. . . . This supremely urbane civilization cultivated genius. Had there been Nobel prizes in 1000, they would have gone almost exclusively to Moslems.
ভাবানূবাদ: খৃষ্টীয় এক হাজার সালে মধ্যপ্রাচ্য ছিল বিশ্বসভ্যতার সূতিকাগার। আরবি না জানা কারো পক্ষে জ্ঞানের জগতে পা রাখার কোন সুযোগ ছিল না। ..... ইসলামের সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে চার শতাব্দি পূর্বে প্রতিষ্ঠিত একটি ইসলামি সভ্যতার ব্যাপ্তি ঘটে বিশ্বের সবচেয়ে মেধাবি ব্যক্তিদের অবাধ জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে। বিভিন্ন ইসলামি গোত্রগুলোই যে সেকালে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বিবেচনায় বিশ্বে সর্বোচ্চ (সুপার পাওয়ার) শক্তিধর ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। বিস্ময়কর এ শহুরে সভ্যতা প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছে। সেই এক হাজার সালে যদি নোবেল পুরস্কার প্রদানের কোন ব্যবস্থা ও প্রথা থাকতো, তা হলে তার সবক’টিই একচ্ছত্রভাবে মুসলমানদের দখলেই যেতো।
অতএব, বিশ্বজুড়ে ইহুদিদের বিষয়ে যে মিথ ছড়িয়ে আছে বা রাখা হয়েছে, তার কোন ভিত্তি নেই। ইহুদি কিংবা সমগোত্রীয় যে কোন শত্রæর বিরুদ্ধে সফল হতে চান? হাতে গোণা কয়েকটা কাজ করতে হবে মাত্র,
এক: আপনার নিজ আদর্শের (ধর্ম ও সংস্কৃতি) প্রতি একনিষ্ঠ থাকুন,
দুই: নিরন্তর জ্ঞানচর্চা করুন ও নিজেকে জ্ঞানে বিজ্ঞানে আপটুডেটড রাখুন,
তিন: ইহুদিদের সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র; নারী, এ টোপ এড়িয়ে চলুন দেখবেন আপনিও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন।
[লেখক, গবেষক জিয়াউল হকের ফেসবুক টাইম লাইন থেকে]