তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) একত্রিকরনের ফলস্বরূপ আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যা ফোর আই আর নামে পরিচিত। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা),রোবট,ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি),স্বায়ত্তশাসিত যানবাহন, থ্রিডি প্রিন্টিং(ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ)এবং ন্যানো প্রযুক্তি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নতুন উদ্ভাবন । বিগ ডেটা ব্যবহার করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অনেকগুলি নতুন প্রযুক্তি ডিজিটাল বিশ্বকে একীভূত করার মাধ্যমে এগ্রিবিজনেস তথা কৃষি ব্যবসা সেক্টরে প্রভাব ফেলবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কৃষি-সংক্রান্ত ব্যবসাকে সহজ এবং কম ব্যয়বহুল করে তুলবে বলে আশা করা হচ্ছে। স্মার্ট ফার্মিং টুলস অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ডিজিটাল ফাইন্যান্সিং এবং গ্রামীণ এলাকায় প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য সাশ্রয়ী প্রশিক্ষণ সবই কৃষি ব্যবসার চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনাকে বেগবান করার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। চাষাবাদের জন্য স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা এবং গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি কৃষি সেক্টরকে প্রাণবন্ত করতে উল্ল্যেখ যোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।প্রায় দুইশ বছর আগে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার নব্বই শতাংশের বেশি মানুষ কৃষি খাতে যুক্ত ছিল;কিন্তু বর্তমানে সেবা খাতের সাথে সংশ্লিষ্টতা বেশি। কৃষকরা বিগ ডেটা এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে জটিল তথ্যে প্রবেশাধিকার পেতে পারে যা তাদের চাষাবাদের ক্ষেত্রে আরও ভাল সিদ্ধান্ত গ্রহনে সাহায্য করবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অর্জিত ডেটার মূল্যায়ন ও রূপান্তর করার মাধ্যমে খামার ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ উন্নতকরন করা সম্ভবপর হবে।পৃথক প্রাণী এবং গাছপালা থেকে অর্জিত ডেটা রূপান্তর থেকে শুরু করে একটি খামারের সম্পূর্ণ ফসল পরিকল্পনা এবং পর্যবেক্ষণের জন্য তথ্য প্রদর্শন করা পর্যন্ত এটি সকল পর্যায়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। সার এবং রাসায়নিক প্রয়োগের মতো ইনপুটগুলি আরও ভাল বন্টন এবং পুনরায় উৎপাদন করার মাধ্যমে এগ্রিবিজনেস সেক্টর বিগ ডেটা এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স থেকে উপকৃত হতে পারে। রোবট কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন,প্রক্রিয়াজাতকরণ,বিতরণ এবং ব্যবহারসহ কৃষি প্রক্রিয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ করবে।উদাহরণ স্বরূপ-কৃষি পণ্য নির্বাচন,স্বয়ংক্রিয় বিতরণ ব্যবস্থা এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাণিসম্পদের যত্ন নেয়া ইত্যাদি। ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি)এবং মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার করে কৃষি ব্যবসা ও কৃষি কাজের নিরাপত্তা,দূরবর্তী চিকিৎসা এবং বয়স্ক কৃষকের জীবন নিরাপত্তা সংশ্লিস্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি) এর ব্যবহার বাস্তবায়ন করা সম্ভব। মানুষ থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের জন্য খাদ্য,খামারের উপকরণ,কৃষি যন্ত্রাংশ এবং সরঞ্জামগুলির স্ব-উৎপাদনে ব্যক্তিগতভাবে এবং সৃজনশীলভাবে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হবে। ত্রিমাত্রিক প্রিন্টারগুলি অল্পবয়সী এবং বয়স্কদের জন্য পুষ্টিকর কার্যকরী খাবার তৈরি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন-নরম,সহজে চিবানো যায় এমন প্রক্রিয়াজাত খাবার। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বিনির্মানের মাধ্যমে প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ও কৃষি ব্যবসা সহজ করতে হবে আসন্ন পঞ্চম-প্রজন্মের (ফাইভ জি)যোগাযোগ নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচার এবং ক্লাউড সার্ভিস সিস্টেম এগ্রিবিজনেস সেক্টরকে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করবে বলে আশা করা যায়।উন্নত দেশগুলোতে এইসব প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চাহিদা ক্রমবর্ধমান। ব্লকচেইন এগ্রিবিজনেস সেক্টরে উৎপাদনকারীর রাজস্ব বাড়াতে পারে এবং চুক্তি ও লেনদেন নিরাপদ করতে পারে।যখন এগ্রিকালচারাল সাপ্লাই চেইনে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির কথা আসে,তখন একটি ব্লকচেইন উৎপত্তিস্থল থেকে বিক্রয়ের স্থান পর্যন্ত একটি অপরিবর্তনীয় রেকর্ড (ট্রেসযোগ্যতা) প্রদান করে সাহায্য করতে পারে। উপরন্তু, ব্লকচেইন কৃষি পণ্য উৎপাদনকারী বিশেষ করে কৃষকদের ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট উন্নতকরন এবং ফুড ভ্যালু চেইনকে সহজসাধ্য করে তাদের আয় বাড়াতে সাহায্য করতে পারে,যার ফলে কৃষকদের উচ্চ আয় অর্জনের পথ প্রশস্ত হয়। একটি ব্লকচেইন ডিজাইন নিরাপদ এবং এটি চুক্তি ও লেনদেনের নিরাপত্তায় সাহায্য করতে পারে।যেমন-জমি নিবন্ধন এবং শস্য বীমা। ফসল পর্যবেক্ষণ,ফসলের পরিমাণ নির্ধারণ এবং মূল্যায়ন,ফসলের তালিকা,নির্ভুল স্প্রে করা,খামারের অবকাঠামো পরিদর্শন, প্রেসক্রিপশন ম্যাপ তৈরি করা,উচ্চ-রেজোলিউশন ম্যাপিং এবং পৃথক ফসলের মাঠের জরিপ,ফসলের ক্ষতির মূল্যায়ন কৃষিতে ড্রোন প্রযুক্তির প্রধান প্রয়োগ।ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমানে ফসলের মাঠে ব্যক্তিগতভাবে পরিদর্শনের প্রয়োজনীয়তা সীমিত করা সম্ভব।সুতরাং এগ্রিবিজনেস প্রেক্ষাপটে ড্রোন ব্যবসার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈশ্বিক কর্মশক্তি কৃষি খাত থেকে দূরে সরে গেছে এবং উৎপাদন ও সেবা খাতে ধাবিত হয়েছে।সেজন্য বাস্তবতার নিরীখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের মতো উন্নত দেশগুলো কৃষি সংক্রান্ত উদ্বেগজনক পরিস্থিতি মোকাবেলায় যান্ত্রিকীকরণ, স্বয়ংক্রিয়করণ এবং আধুনিকীকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে কৃষির আকার সম্প্রসারণ এবং বাণিজ্যিকীকরণ অর্থাৎ এগ্রিবিজনেস সেক্টরের অনেক দ্বার উন্মোচনের সুযোগ রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বিগ ডেটা কৃষি সংশ্লিস্ট খাতে অন্তর্ভুক্ত করার ফলে ভবিষ্যৎ কৃষি উচ্চ-প্রযুক্তি ব্যবসায় সম্প্রসারিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।কৃষি যন্ত্রপাতি,মাটি,বীজ,খামার ব্যবস্থাপনা,উৎপাদন পূর্বাভাস এবং সেচ একটি ইন্ত্রিগ্রেটেড সিস্টেমে একসাথে একত্রিত থাকবে।রোবট,বিগ ডেটা এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মূলত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মূল প্রযুক্তি কৃষির সাথে যুক্ত হয়ে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।বহুমুখী অর্থনৈতিক,সামাজিক এবং নৈতিক নীতিগুলি অসংখ্য শিল্পের সাথে একত্রিত হবে এবং সময়ের সাথে এগ্রিবিজনেস সংক্রান্ত বিভিন্ন ব্যবসায়িক মডেলগুলোতে প্রকাশিত হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নানাভাবে এগ্রিবিজনেস খাতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।যেমন-নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য,সঠিক অপ্টিমাইজেশন বর্তমান এগ্রিবিজনেস বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করবে। এগ্রিবিজনেস এমন একটি ব্যবসা ক্ষেত্র যেখানে বিস্তৃত ইনপুট এবং আউটপুট রয়েছে। গ্রামীণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষিতে মানব সম্পদের প্রত্যাবর্তন উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।পুঁজি শ্রম এবং প্রযুক্তিগত কারনে যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে কাজের সন্ধানে এসেছিল,চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারনে পুনরায় তাদের গ্রামে ফিরে কৃষিকাজের মধ্যে নিয়োজিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তি আবহাওয়া সংক্রান্ত সমস্যাগুলির উপর একটি বড় প্রভাব ফেলবে।কৃষি ক্ষেত্রে আবহাওয়ার একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বর্তমানে সঠিকভাবে আবহাওয়া অনুমান ও নিয়ন্ত্রণ করার সরঞ্জামের অভাব রয়েছে।যে কারনে কৃষিকাজ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানুষের অভিজ্ঞতাসহ জ্ঞান এবং অন্তর্দৃষ্টির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।চতুর্থ শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তির এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে যা মানুষের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার চেয়ে উচ্চতর। এটি এমন সমস্যাগুলির সমাধান করবে যা বিদ্যমান প্রযুক্তি সমাধান করতে পারে না।যেমন-অত্যধিক প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ,প্রাণীর গন্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি ইত্যাদি।ফলস্বরূপ,আমাদের বর্তমান শিল্প বিপ্লবের বিপরীতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব একটি এগ্রিকালচার ও এগ্রিবিজনেস বান্ধব বিপ্লব হিসাবে দেখা যেতে পারে।একই সময়ে এটি অর্থনীতি,সমাজ এবং দৈনন্দিন জীবনে আরও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটাবে বলে আশা করা যায়। বাংলাদেশে অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (এ্যাডাস্ট) ২০ এপ্রিল ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে এগ্রিবিজনেস বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে এবং এগ্রিবিজনেস বিষয়ের উপর উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে। এগ্রিবিজনেস বিভাগ হতে পাসকৃত সকল মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা দেশের কৃষি উন্নয়নের জন্য অবদান রাখছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগ্রিবিজনেস সেক্টরের প্রসার ও উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রতিযোগিতামূলক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যোগ্য করে তোলার জন্য অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি(এ্যাডাস্ট)এর এগ্রিবিজনেস সহ সকল বিভা্গের শিক্ষকগণ নিরলসভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে বদ্ধ পরিকর। লেখকবৃন্দঃ মোঃ মাসুদুল হাসান সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় কো-অর্ডিনেটর, এগ্রিবিজনেস বিভাগ অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (এ্যাডাস্ট)। মোঃ নিয়াজ মোস্তাকিম সহকারী অধ্যাপক,ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই)বিভাগ অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (এ্যাডাস্ট)। সামিরা ইসলাম রেশমী সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় কো-অর্ডিনেটর, এগ্রিবিজনেস বিভাগ অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (এ্যাডাস্ট)।